রজনীকান্ত সেনের গান

রজনীকান্ত সেনের গান নিয়ে আজকের আয়োজন। রজনীকান্ত সেন (২৬ জুলাই, ১৮৬৫ – ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১০) প্রখ্যাত কবি, গীতিকার এবং সুরকার হিসেবে বাঙালি শিক্ষা-সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি “কান্তকবি” নামেও পরিচিত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমসাময়িক এই গীতিকারের গানগুলো খুবই জনপ্রিয়। ঈশ্বরের আরাধনায় ভক্তিমূলক ও দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ বা স্বদেশ প্রেমই তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও উপজীব্য বিষয়।

 

রজনীকান্ত সেন

 

রজনীকান্ত সেনের গান :

রজনীকান্ত শৈশবকাল থেকে সঙ্গীতপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। কোথাও কোন সুমধুর সঙ্গী শুনলেই তিনি সুর, তাল-সহ তৎক্ষণাৎ তা কণ্ঠস্থ করতে পারতেন। তার পিতা গুরুপ্রসাদ সেন একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ফলে পিতার সাহচর্য্যেই শৈশবে সঙ্গীত অনুশীলন করার সুযোগ ঘটে তার। বস্তুতঃ কাব্যের চেয়ে গানের ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব অধিক। যৌবনে সঙ্গীত রচনায় বিশেষ পারদর্শীতার পরিচয় প্রদান করেন রজনীকান্ত।

অক্ষয়কুমারের বাসভবনে আয়োজিত গানের আসরে তিনি স্বরচিত গানের সুকণ্ঠ গায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন । রাজশাহীতে অবস্থানকালে রজনীকান্ত সেন তৎকালীন সময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলালের কণ্ঠে হাসির গান শুনে হাসির গান রচনা শুরু করেন। অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে গান রচনায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। তিনি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখনীর দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তার মতো করে সমগোত্রীয় লেখা লিখতে শুরু করেন।

তার রচিত গানগুলোকে বিষয়বস্তু অনুযায়ী চারটি ভাগে বিভাজিত করা হয়েছে –

  1. দেশাত্মবোধক গান
  2. ভক্তিমূলক গান
  3. প্রীতিমূলক গান
  4. হাস্যরসের গান।

তন্মধ্যে – রজনীকান্তের দেশাত্মবোধক গানের আবেদনই বিশাল ও ব্যাপক। স্বদেশী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) চলাকালে ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’ গানটি রচনা করে অভূতপূর্ব গণআলোড়নের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন।

 

রজনীকান্ত সেনের গান
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আসুন দেখে নেই তার গানের সম্ভার:

আজি দীন নয়ন সজল

আজি দীন নয়ন সজল করুণ, কেন রে পরাণ কাঁদে-
লুটাইয়া অবসাদে?
সোনার স্বপন ভাঙ্গিল নিয়তি নিঠুর চরণাঘাতে!
মরমের কোণে লুকাইল আশ,
কোরকে ঝরিল কুসুম সুবাস,
তপ্তবেদনা বহিয়া, বাতাস
মুরছি পড়ে বিষাদে!
অন্ধ তিমির উজলি কিরণে,
আনি জাগরণ সুপ্ত নয়নে,
উদলি অরুণ পূর্ব-গগনে,
ডুবে গেল পরভাতে!
দেখরে জ্ঞান-সাগর যাত্রী,
উষার তোদের আসিল রাত্রি;
কে আর অকূলে লয়ে যাবে তরী-
কে আর যাইবে সাথে?

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

কোন্ সুন্দর নব প্রভাতে

কোন্ সুন্দর নব প্রভাতে,
তুমি উদিলে, ধরা জাগিল হে!
স্নিগ্ধ মলয় বহিল মন্দ,
বনকুসুম
তব বদনচুম্ব মাগিল হে!
দুখ মিনগনে, ধরাবাসিজনে,
আনন্দকিরণে ভাসিল-
মোহ-জলদ সরিল, সবারি হৃদয়-
আঁধার টুটিল হে;
জয় মঙ্গল রূপী নবরবি রবে
সবে বন্দন গাহিল হে!
আবার সান্ধ্যগগনে সি-মিত করিণে
চলিরে, নিভিল উজল ভাতি হে,
অস-, নিখিল ব্যস্ত, দিয়ে গেলে
দুখরাতি হে,
সবে ডুবিল ঘোর অন্ধ তিমিরে,
নিরাশায় চিত ভরিল হে!
আর কি কভু এ ভাগ্য-গগনে
উদিবে করুণা করিয়া?
দাঁড়াও! সৌম্য-মুরতি হেরি,
এ তৃষিত নয়ন ভরিয়া
তবে মিলনের ভয়ে বিরহ ভীতি
হৃদয় আকুল করিল হে।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

তব শান্তি-অরুণ শান্ত-করুণ

তব, শান্তি-অরুণ- শান্ত-করুণ
কণক কিরণ পরশে,
জাগে প্রভাত হৃদি-মন্দিরে,
চরণে নমিয়া হরষে!
আরতি উঠে বাজিয়া ধীরে,
সৌরভ ছুটে মৃদু-সমীরে,
প্রেম-কমল হাসে,
ভাসে শান্ত মরম সরসে।
সংশয়, দ্বিধা, তর্ক দ্বন্দ্ব,
দূরে যায়, বিমলানন্দ,
পানে জ্ঞান নয়ন সফল,
প্রীতি-অশ্রু বরষে!

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

বিবেক বিমল জ্যোতিঃ

বিবেক বিমল জ্যোতিঃ
জ্বেলেছিলে তুমি হৃদয় কুটীরে;
তোমারি আলোকে তোমারে দেখেছি;
তোমারি চরণ ধরেছি শিরে!
যৌবনে, হরি, ছাইল ভীষণ
অবিশ্বাস-ঘন-মেঘে;
বহিল প্রবল পাপ পবন;
ডুবাইল ঘোর অন্ধ-তিমিরে।
আরো একবার এস, প্রভু, এস,
দীপ্ত মিহির রূপে,
পাপ যামিনী পোহাইবে ঊষা
উদিবে পুন্য কিরণে, ধীরে।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

দীন নিঝর, ক্ষীণ জলধারা

দীন নিঝর, ক্ষীণ জলধারা
ঝরে ঝর ঝর গিরি অরণ্যে,
কে করে সন্ধান, অতি ক্ষুদ্র প্রাণ,
অতিশয় তুচ্ছ, অতি নগন্যে।
অতিক্রমি যাবে পাষাণের স’পে,
নেমে, আসে ভীম-সোতস্বতীরূপে,
প্লাবি দু্ই কুল, এ বিশ্ব ব্যাকুল
ছুটে আসে লয়ে পিপাসা দৈন্যে।
ক্ষুদ্র বীজ যবে হয় অঙ্কুরিত,
ভঙ্গুর, পেলব, ক্ষুদ্র, সঙ্কুচিত,
ক্রমে মহাবৃক্ষে হয়ে পরিণত,
ফল-পুষ্প ছায়া বিতরে অন্যে।
যদিও এ বাহু নহে কর্ম-ক্ষিপ্র,
তথাপি উদ্যম অবিচল, তীব্র;
বাধা পদে দলি, ধীরে যাও চলি,
বিপদে, সম্পদে স্মরি শরণ্যে।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

আর কি ভাবিস্ মাঝি বসে

আর কি ভাবিস্ মাঝি বসে
এই বাতাসে পাল তুলে দিয়ে
হাল ধরে থাক্ কসে।
এই হাওয়া পড়ে গেলে,
স্রোতে যে ভাই নেবে ঠেলে,
কুল পাবি নে, ভেসে যাবি,
মরবি যে মনের আপসোসে।
মিছে বকিস আনাড়ি,
এই বেলা ধরে রে পাড়ি;
পাঁচ পীর বদর বলে,
পুরো মনের খোশে।
এমন বাতাস আর রবে না,
পারে যাওয়া আর হবে না,
মরণ সিন্ধু মাঝে গিয়ে,
পড়বি নিজ কর্মদোষে।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

কে দেখবি ছুটে আয়

কে দেখবি ছুটে আয়,
আজ গিরিভবন আনন্দের তরঙ্গে ভেসে যায়!
ঐ মা এল, মা এল বলে
কেমন ব্যগ্র কোলাহলে,
উঠি পড়ি করে সবাই আগে দেখতে চায়।
নিষ্কলঙ্ক চাঁদের মেলা
শ্রীপদ নখে কচ্ছে খেলা,
একবার ঐ চরণে নয়ন দিয়ে, সাধ্য কার ফিরায়?
কি উন্মূক্ত শোভার সদন,
ফুল্ল অমল কমল বদন,
সিদ্ধি, শৌর্য্য, সোনার ছেলে অভয়-কোলে ভায়
কান্ত কয়, ভাই নগরবাসী!
তোদের সপ্তমীতে পৌর্ণবাসী,
দশমীতে অমাবস্যা, তোদের পঞ্জিকায়।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

শুনাও তোমার অমৃত বাণী

শুনাও তোমার অমৃত বাণী,
অধমে ডাকি, চরণে আনি।
সতত নিষ্ফল শত কোলাহলে,
ক্লিষ্ট শ্রুতি যুগ কত হলাহলে
শুনাও হে-
শুনাও শীতল মনোরসায়ন
প্রেম-সুমধুর মন্ত্রখানি।
হউক সে ধ্বনি দিক প্রসারিত
মিশ্র কলরব ছাপিয়া,
উঠুক সে ধবনি শিহরি’ পুলকে
কাঁপিয়া, সুখে কাঁপিয়া,
বিতরি’এ ভবে শুভ বরাভয় ;
রুগ্মে করি’;হরি চির নিরাময়,
শুনাও হে-
শুনাও দুর্বল চিত্ত, হে হরি!
তোমারি শ্রীপদ নিকটে টানি।।

 

রজনীকান্ত সেনের গান

 

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment