আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কবির কেরামতি। চারণ কবি পাগলা কানাই শুধু এক জন গায়কই ছিলেন না। তিনি ছিলেন। একাধারে সাধক, কবি সুরকার ও গায়ক। সর্বপরি, তিনি ছিলেন কামালিয়াতের একজন খাঁটি মুসলমান । অত্র অঞ্চলেই শুধু নয়, দেশ-বিদেশে তার সম্বন্ধে বহু কেরামতির কথা প্রচলিত আছে। এখানে কয়েকটা মাত্র উল্লেখ করা হলো।
Table of Contents
কবির কেরামতি

(১) কালী মন্দিরের পার্শ্ব পারিবর্তন
একবার ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানাধীন বেণীপুর গ্রামে কবি পাগলা কানাই এক পাল্লা গান করতে যান । কি এক কারণে কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে । উভয় দলই কবিকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকে। শেষে কবি দাওয়াত দানকারী দলকেই সমর্থন করেন। আর এদলই ছিলো দুর্বল । ফলে অপর পক্ষ কিছুতেই কালী মন্দিরের সামনে গান করতে দিল না। শেষে কবির পরামর্শে কালী মন্দির ছেড়ে একটু দূরে উত্তর পাশে আসর করা হলো ।
যথা সময়ে আসর শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত সমস্ত শ্রোতা মণ্ডলী এই জলসাতে উপস্থিত হয়ে পড়লো । শুধু তাই নয়, সবাই প্রত্যক্ষ করলো যে কালী মন্দিরের মুখও উত্তর দিকে ঘুরে গিয়েছে। কালী মন্দির ঘোরার কাহিনী বহু স্থানে প্রচলিত আছে। ড. মযহারুল ইসলাম সাহেব রচিত ‘কবি পাগলা কানাই’ পুস্তকে রজশাহীতে এরূপ একটা ঘটনার উল্লেখ আছে । শ্রুতি ও কবি বংশধরদের থেকেও এরূপ ঘটনার সত্যতা মেলে ।
(২) নৌকা তোলা
কবির জন্ম ভূমি বেড়বাড়ির দহতে একবার কবির শিষ্য কদম আলি মণ্ডলের এক মাল বোঝাই নৌকা ডুবে যায় । দহতে পানি ১২/১৪ হাত। বর্ষার সময়। স্রোত খুব । কদম আলী ভেউ ভেউ করে কাদতে লাগলো। তারও কিছু মালামাল তাতে ছিল ।
কবি সে কান্না সইতে না পেরে শিষ্যকে আশ্বাস বাণী দিয়ে ফিরলেন । পরদিন খুব ভোর রাত্রে কয়েকটা কাছি ও একখানা কোদাল নিয়ে দহতে নেমে পড়লেন। ঘণ্টা খানেক পর কবি পানির উপর মাথা তুললেন । বললেন, কাছির মাথায় গরু জুড়ে টান দাও। এই বলে আবার ডুব দিলেন। কদম মণ্ডল তাড়াতাড়ি দশ জোড়া গুরু এনে কাছির মাথায় জুড়ে টানতে লাগলো । নৌকা আস্তে আস্তে কুলে ভিড়লো। দেখা গেল কবি নৌকার গলুইয়ের উপর বসে আছেন’ ।
(৩) বৃষ্টির দিনে মেজবানি
ঝিনাইদহ থানাধীন কামারকুণ্ডু গ্রামে কবির এক ভক্ত ছিলো । ঐ ভক্ত বাড়িতে এক মেজবানীর আয়োজন করে। দুর্ভাগ্যক্রমে দিনের দিন সকাল থেকে অবিরামে বৃষ্টি আরম্ভ হলো । কবিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ভক্ত এ অবস্থায় বিপাকে পড়ে একেবারে মুষড়ে পড়ে। কবিও ভক্তের বিপদে স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন,“তাড়াতাড়ি কাজ সমাধা করে ফেলো”। এই বলে সেই গরমের দিনে লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। যতক্ষণ শুয়ে ছিলেন, আর বৃষ্টি হয় নি ।
(৪) আগুনের মধ্যে কবি
১) মহাদেব নায়ক শর্মা ও পঞ্চাননী নায়ক শর্মার পরিবারে কবি পাগলা কানাইয়ের যাতায়াত ছিলো। কবি তাদের আজা ও আজী বলে ডাকতেন। তারাও কবিকে খুবই ভালোবাসতেন। একদিন কবি দেখতে পেলেন আজী রস জ্বাল দিচ্ছেন । কবি ঐখানে বসেই গল্প জুড়ে দিলেন । কিছুক্ষণ পর আজী অন্যত্র উঠে গেলেন এবং কি একটা কাজে আটকা পড়ায় বেশ একটু দেরী হয়ে গেলো ।
এদিকে জ্বাল বন্ধ হবার উপক্রম হলো। জ্বাল বন্ধ হলে রস নষ্ট হবে ভেবে কবি বাইনের মধ্যে একখানা পা ঢুকিয়ে বসে তামাক টানতে লাগলেন। বাইন দাও দাও করে জ্বলতে লাগলো ।
২) একবার শর্মা মশায়ের সাথে একটা গাভী বাজী রেখে কবি এক জ্বালা টগবগে গরম রস খেয়ে ফেলেন । কিন্তু কৰি শেষতক গরুটা নেন নি ।
৩) এক দিন আজী পঞ্চাননীর কাছে গুড় খেতে চাইলে তিনি বললেন, তোর তো আর অসাধ্য বলে কিছুই নেই । পারিস যদি জ্বালা থেকে তুলে খা । কবি বললেন, খেতে পারলে কি দেবে আমায় । তুই যা চাবি তাই পাবি আজী বললেন ।
পুনঃ কবি বললেন, তোকেই আমার চাই । আজী কবির মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন তুই যে আমার ঠাকুর । কবি গরম গুড় খেয়ে আজীকে অবাক করে দিলেন । এসব ঘটনায় শর্মা পরিবার খুবই আশ্চর্য হন । তারা কবিকে কলির কৃষ্ণ বলে আখ্যায়িত করেন । কবিকে তারা নাম ধরে ডাকতেন না। ঠাকুর বলে ডাকতেন ।
(৫) কবি ও দস্যু দল
একদা গ্রামের জনৈক উমাচরণের বাড়িতে এক সশস্ত্র ডাকাতি পড়ে। ঐ সময় ভারী রাত্রে কবি কোথা থেকে ফিরছিলেন। নাপিত বাড়ি গোলমাল শুনে তিনি এগিয়ে যান এবং উমাচরণের নাম ধরে ডাক দিলেন । কিন্তু উমাচরণের পরিবর্তে এগিয়ে এল কয়েকজন ডাকাত ।
তারা কবিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। তারা কয়েক পদ অগ্রসর হতেই পুতুলের ন্যায় দাঁড়িয়ে গেলো । কোন অবস্থাতেই মুরিদ হলো। জানা যায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা সততার সাথে জীবিকা তারা স্থান ত্যাগ করতে পারলো না ।
শেষ পর্যন্ত তারা কবির কাছে তওবা পড়ে নির্বাহ করে জীবন কাটায়। টীকাঃ- এ ঘটনাটা উমাচরণের পৌত্র সুরেন্দ্রনাথ কর্মকার কর্তৃক পরিবেশিত। সুরেন্দ্রনাথের পিতার নাম শীতল কর্মকার । বাড়ি বেড়বাড়ি ও ফকিরাবাদের ভাগে বর্তমান নাম কেলোর বাড়ি। শীতল কর্মকারের লাগানো আম গাছ আমরা দেখেছি । গাছের নাম ছিল ‘শীতল পাটালী’।
(৬) বন্দুকের গুলি বন্দ করা
বেড়বাড়ির উত্তরে অবস্থিত ফকিরাবাদ গ্রামস্থ জনাব আরজু খোন্দকারের একটু গাঁদা বন্দুক ছিল। তিনি একদিন বিকালে পাখি শিকারের জন্য বেড়বাড়ি আসেন। কবির বাড়ি সংলগ্ন অনেকগুলি গাছ-গাছালির মধ্যে কয়েকটা বিরাট তেঁতুল ছিল । কবির মায়ের হাতের সে সব গাছগুলি আমরাও দেখেছি । ঐ সব গাছে বিভিন্ন ধরনের পাখ-পাখালী বাস করতো । খোন্দকার সাহেব গাছে তাক করলেন । কবি সাহেব নিষেধ করে লোক পাঠালেন। তিনি শুনলেন না ।
ঘোড়া টিপে দিলেন । কিন্তু গুলি আর বের হলো না। অনেক টিপাটিপি করেও কোন কাজ হলো না। সাধক ও সাত্ত্বিকের-১ কাছে যেমন অজানা কিছুই থকে না, তেমনি তার সাথে কোন ছল-চাতুরীও খাটে না। খোনকার সাহেবের অহংকার ধুলায় ধুলিস্যাত হয়ে গেল । কবি সাহেব বের হয়ে আসলেন । মৃদু হেসে বললেন খোনকার সাহেব, ও গুলি আর বের হবে না। ওরা আমার আশ্রয়ে আছে। আপনি মারবেন, তা কি হয়।
খোনকার সাহেব সত্যিই লজ্জিত হয়ে পড়লেন । তিনি কবিকে বললেন যে, তার ভুল হয়েছে । কবি কিছু কী পড়ে ফু দিয়ে দিলেন-ফায়ার হয়ে গেলো/কবি নিজেই ফায়ার করে গুলি বের করে দিলেন । এরপর থেকে খোনকার সাহবে আর কখনও পাখি শিকার করেন নি। এবং বন্দুকটাও বিক্রি করে দেন।
(৭) ইদু বিশ্বাসের কথা বন্দ হওয়া
একবার কবির প্রধান শিষ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বী ইদু বিশ্বাসের মনে বড়ই অহংকার আসে যে তিনি ওস্তাদের থেকেও সাধনায় ও কবিত্বে সমকক্ষ বা এক ধাপ এগিয়ে গেছেন। এ অহংকার হেতু একদিন এক পাল্লা গানে ওস্তাদকে অন্যায় ভাবে এবং পান্নার নিয়ম-নীতিহীন ভাবে গালি-গালাজ করেন। এতে কবি মনে মনে অভ্যস্ত। দুঃখ পান।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো ইদু বিশ্বাস বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। বিষয়টা তিনি বুঝে ফেল্লেন। এবং ওস্তাদের দু’পা জড়িয়ে ধরলেন। তিনি সর ভুলে গেলেন এবং দোয়া করলেন । কিছুক্ষণ পর ইদু বিশ্বাসের বাক শক্তি ফিরে আসে।

(৮) বিমার মুক্ত হাকিম
একবার ঝিনাইদহ মহকুমাতে এক প্রশাসক (এস.ডি.ও.) সাহেব আসেন। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। কারণ বহুমুত্র রোগ। শোনা যায়, রোগটা এমন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় যে সর্বদা ফোঁটা ফোঁটা প্রস্রাবের সাথে পূজ-রক্ত পড়ত। বহু চেষ্টা করেও তিনি এ রোগ সারাতে পারেন না। শেষে থানা ইন্সপেক্টার বাবু হরিশ চন্দ্র সরকারের (১০৮ নং পদ দেখুন) পরামর্শ ও অনুরোধে চারণ কবিকে ডাকা হয় ।
সব কিছু শোনার পর কবি মহকুমা প্রশাসককে বললেন, “হুজুর, সব কিছুই তার (আল্লাহর) ইচ্ছা। তার ইচ্ছা না হলে কোন ভাল কাজ হয় না। আমার এই পানি পড়া এক সপ্তাহ খেতে হবে ও গোসল করতে হবে। এই সংগে একটা নাম শিখিয়ে দিচ্ছি । প্রতিদিন পবিত্র অবস্থায় এক হাজার বার পড়তে হবে” । এই বলে তিনি নামটা শিখিয়ে দিলেন।
মহান আল্লাহ্র কৃপায় সপ্তাহ মধ্যেই প্রশাসক সাহেব বিমার মুক্ত হন। তিনি নব জীবন লাভ করলেন । পাগলা কানাই বলতে তিনি পাগল হয়ে গেলেন । শোনা যায়, শেষ পর্যন্ত তিনি কবির এতো বড় ভক্ত হয়ে উঠলেন যে তার নিকট তওবা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। এ অপরাধে তিনি চাকুরীচ্যুত হন। তবুও তিনি ঈমান নষ্ট করলেন না।
(৯) লাঠি খেলায় কবি
বেড়বাড়ি গ্রামে মুলক চান্দ সরদার বলে একজন প্রসিদ্ধ লাঠিয়াল ছিলো। তার ৭টা লাঠিয়াল বাহিনী ছিলো। একবার মহররম উপলক্ষে সর্দার সাহেবের বাড়িতে খেলা হচ্ছিল। কবিও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাকে দেখে কয়েকজন খেলোয়াড় উপহাস করে বললো,
-বয়াতি ভাই, আসেন । আপনার লাঠির কেরামতি দেখি ।
সর্দার সাহেবও বলে বসলেন,
-বয়াতি ভাই, এসো দেখি । এক হাত খেলি তোমার সাথে।
উঠে কবি বললেন,
-তোমরা আমার লাঠির কি কেরামতি দেখতে চাও?
-আমরা ডাকাতি খেলার কেমামতি দেখবো।
-ঠিক আছে। তোমাদের ঐ বড় ঘড়াটা পাহারা দাও । আমি ডাকাতি করে কেড়ে নেবো। তবে, মনে করো না এটা নিছক খেলা। ঘড়া নিতে পারলে তা আর ফেরত পাবে না।
একথায় মুলুক চান্দ লাফিয়ে উঠলেন তার দল বল নিয়ে। উৎসুক্য জনতার মধ্যে দেখা গেলো খুশির গুঞ্জন। মাঝখানে ঘড়া রেখে ২০/২৫ জন লাঠিয়াল লাঠি, ঢাল, ভেলা, সড়কি, ছোরা-বল্লম প্রভৃতি অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে পাহারায় রইলো । কবি এক-খানা লাঠি ও ঢাল নিয়ে চার পাশে চক্কোর দিয়ে বেড়াতে লাগলেন । কবি পৌত্র ইমদাদুল হক সাহেব বলেন যে, আল্লার অলীর নিকট কোন প্রকার তামাশা খাটে না। মনে হলো, কবির রক্ত মাংশের শরীরে কিসের একটা ছায়া এসে পড়েছে ।
চোখ দুটো ভাটা ভাটা, রক্ত জবার মতো। শরীরে অমিত তেজ। তিনি আলী আলী বলে হায়দারী হাঁক ছেড়ে বুহ্যের চারদিকে ঘুরতে লাগলেন । মুলুক চান্দ সর্দার আপ্রাণ চেষ্টা করে বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু দেখা গেলো, কোন মুহূর্তে ঘড়া কবির হাতের মুঠোই চলে এসেছে কেউ তা বুঝতেই পারলো না । অহংকারী মুলুক সাহেবর অহংকার ভেঙ্গে গেলো । তিনি মুখ কালো করে খেলার আসর পরিত্যাগ করলেন । পরে কবি ঘড়াটা ফেরত দেন বলে শোন যায় ।
(১০) জমিদার বাহিনী ও কবি
ঝিনাইদহ থানাধীন পবহাটির মহেষ মজুমদার (হরি সরকারের বড় ভাই, ১০৮ নং পদ) বেড়বাড়ি অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। একবার দুর্ভিক্ষের দরুণ বেড়াবাড়ির জনসাধারণ খাজনা দিতে না পারায় জমিদার খাজনার জন্য চাপ দিতে থাকেন। শুধু তাই নয়, বেড়বাড়ির সাধারণ জনগণকে পরহাটী ডেকে এনে অপদস্থ করেন। এতে, তারা খাজনা দেওয়া একেবারে বন্ধ করে দেয়। ফলে, একদিন তিনি বিরাট এক লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে বেড়বাড়ি দখলে আসেন।
খবর পেয়ে কবি গ্রামের কিছু লোকজন নিয়ে জমিদার বাহিনীকে বেড়বাড়ির সীমানায় বাধা দিলেন । কবির হায়দরী হাঁক এর সামনে জমিদার বাহিনীর শক্তি সামর্থ লুপ্ত হয়ে গেলো। পরাজিত বাহিনী ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে পালিয়ে গেলো । মজুমদার মশাইও জুলুম করে আর খাজনা আদায় করেন নি । যে স্থানে এ ঘটনাটা ঘটে তা আজও দো-দাড়ি’র মাঠ নামে পরিচিত।
(১১) উপস্থিত বুদ্ধিতে কবি
জমিদার মহেশ মজুমদারের লাঠিয়াল বাহিনীকে পরাজিত করার পর গ্রামের সব লোকজন পরামর্শের জন্য কবির নিকট আসে। তাদের ভয় এই যে, জমিদার থানা-পুলিশ করে তাদের নামে হুলিয়া বের করতে পারে । কবি পর দিনই থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন । আমরা আগেই বলেছি যে, পুলিশ ইন্সপেক্টর বাবু হরিশ চন্দ্র সরকারের সাথে কবির জানা শোনা ছিল । সব ঘটনা শুনে, হরিশ বাবু সর্ব প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দিলেন।
এ সময় থানার এক নতুন দারোগা চার্জে ছিলেন । তিনি ইন্সপেক্টর সাহেবকে এ বদান্যতার কারণ জিজ্ঞাসা করেন । সরকার মহাশয় বললেন যে, পাগলা কানাইকে ধরে আটকালে দেশের সব লোক খবর পাওয়ার সাথে সাথে আপনার থানা উড়িয়ে দেবে। দারোগা বাবু ইতোমধ্যেই কবির নাম শুনে ছিলেন । তিনি কবির দিকে ফিরে বললেন,
-তুমি নাকি গান করো । -হ্যা বাবু।
-কি গান করো?
– এই ধুয়া-মুয়ো ।
সুয়ো গান তো অনেক শুনেছি, একটা মুয়ো শোনাও তো দেখি ।
কবি মুহূর্ত মধ্যেই উত্তর দিলেন । বললেন,
-জীবনে মুয়ো শোনেন নি? বলেন কি? আমি আপনাকে মুয়ো শোনাতে পালি তবে আমাকে কি দিবেন?
-কি আর দেবো । এই ধরো কাপড়-চোপড় দেবো ।
-কাপড়তো অনেক পেয়ে থাকি, এক খানা চোপড় দেবেন কি? দারোগা বাবুর মুখ থানা কালি হয়ে গেলো । হরিশ বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন । বললেন, হলোতো, পানির ছিটা বৈঠার ঘা। জানেন না, পাগলা কানাই একজন চারণ কবি ।

চারণ কবি পাগলা কানাই কবিতা প্রসঙ্গে
চারণ কবি পাগলা কানাই এর জীবন চরিত বর্ণনা করতে গেলে তাঁর রচিত কবিতা বা গানগুলো স্বভাবতই এসে যায়। কবিতাগুলো সংগ্রহের ব্যাপারে অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত ও শিক্ষিত ব্যক্তি, বয়াতি, গায়ক, চাষী, মজুর, কাউরা, মাঝি প্রভৃতি সাধারণ লোকের নিকট থেকেই সংগৃহিত হয়েছে । আন্তর্জাতিক গান সংগ্রহের নিয়মানুযায়ী, আমি যে ভাবে পেয়েছি সেভাবেই সংকলন করতে চেষ্টা করেছি। মারাত্বক ধরনের ভুল উচ্চারণ ও বানান সমূহ সংশোধন করে কবিতার অর্থ বোধগম্য করা হয়েছে।
প্রয়োজনে কতক কবিতা বর্জন করেছি। ফলে, আমার সংগৃহিত কবিতাবলীর সংগে অন্যান্য মহতীদের সংগৃহিত কবিতাবলীর মধ্যে হুবহু মিল থাকে নি । তাছাড়া একই কবিতা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকার পাঠ দেখা দিয়েছে। এতে আমার দোষ কি? বরং আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করায় পাপ । তবে, এ কথা সত্য যে, কবিতাগুলোতে শ্রুতি বিভ্রাট, উচ্চারণ ত্রুটি ও বোধগম্যতার জন্য বিভিন্ন প্রকার পাঠ দেখা দিয়েছে। তবুও আমার সংগৃহিত পাঠগুলি যথার্থ ও সঠিক বলে মনে করি ।
কানাই-সংগীতের মধ্যে দেশি-বিদেশি ও আঞ্চলিক শব্দ বিশিষ্ঠ অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। ফলে, অনেক ক্ষেত্রেই কবিতার অর্থ ও বোধগম্যতা কঠিন হয়ে পড়েছে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে কিছু কিছু কঠিন শব্দের অর্থ করে দেয়ার চেষ্টা করেছি। তবে, পল্লী কবি জনাব জসীম উদ্দীন সাহেবের কথায় আমরা বলতে পারি যে,“কানাই সংগীতের প্রকৃত অর্থ ও মর্ম কি তা আমরা সহজে বুঝি না” ।
কানাই সংগীতের সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক ও শাস্ত্রীয় মূল্যবোধকে বিশ্লেষণ এবং শিষ্য-প্রশিষ্য ও সমসাময়িক লোক কবিদের উপর তার প্রভাব নির্ণয়ের জন্য তাদের কিছু কিছু কবিতা পরিশিষ্ট অধ্যায়ে সংযোজিত হলো। যাতে করে সমালোচকের দৃষ্টিতে সহজে কবির কবিতাগুলোর গুরুত্ব ও মূল্য নির্ণয় করা সহজ হয়।
আরও দেখুনঃ
