আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় পাগলা কানাই এর পূর্বাভাস। প্রায় নব্বই বছর পূর্বে ড. মুহঃ শহীদুল্লাহ সাহেব এক ভাষণে বলেছিলেন, “বাতাসের মধ্যে বাস ক’রে আমরা ভুলেই যাই যে, বায়ু সাগরে আমরা ডুবে আছি, তেমনি পাড়াগায়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে, এখানে কত বড় সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ ছিটিয়ে আছে”।
এ ধরনের পল্লী সাহিত্যের রচয়িতা লোক-সাহিত্যিক বাংলার প্রতিটি গ্রামেই যে অন্তত দু’এক জন করে আবির্ভূত হয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিও এসব লোক-কবিদের (বিশেষ করে প্রচারকারীদের হাতে) বিভিন্নমুখি লোক-সাহিত্য নানাভাবে পরিবর্তিত ও বিকৃত হয়ে ভাষা গঠনের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে, তবুও সকলেই একথা এক বাক্যে স্বীকার করবেন যে, এর সাহিত্যিক মূল্যবোধ’ অপরিসীম।
Table of Contents
পাগলা কানাই এর পূর্বাভাস

মারফতি, মুর্শিদী, জারি, সারি, রাখালি, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি গানে বাঙ্গালীরা বিভিন্ন পালা-পার্বণে, ঈদ, মোহররম, পূজা, বিয়ে, মুখে-ভাত, ধান-কাটা, নৌকা বাইচ, প্রেম-প্রীতি এমনি নানা ধরনের বিচিত্র বিষয় নিয়ে এসব লোক-সাহিত্য বাংলার গীতিভাণ্ডার পূর্ণ করেছে তার ইয়ত্তা নেই ।
এসব গীতি-কবিতা আমাদের হৃদয় তন্ত্রীতে যে সাড়া জাগিয়ে দেয়, অন্য কোথাও তা পাওয়া যায় না। বস্তুতঃ এসব হৃদয় স্পর্শী সঙ্গীত আমাদের অজানা ও অমূর্ত লোকের সন্ধানে পৌঁছে দেয়, যেখানে মনটা শুধুই আতি-পাতি করে কি যেন খুঁজে ফেরে । কারণ, “এইসব গানগুলোতে কোন পাণ্ডিত্য নেই, সহজ ভাবে যা এসেছে তা সহজ ভাবেই হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে”।
অর্থাৎ সাধারণ লোকের কাছে সহজ ও সরলভাবে এর গুঢ় রহস্য পৌঁছে দেয়ায় এর বিশেষ বৈশিষ্ট । অথচ, আমরা বুঝতেই চাই না, এসব লোক সাহিত্যে কত প্রেম, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, কত তত্ত্বকথা আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ।
“বাংলার পল্লীতে বাস করেন অথচ ধুয়ো, জারী, ভাব, কবি প্রভৃতি গান শোনেন নাই, এমন লোক বোধহয় খুব কমই আছেন। এই সব গানের রচয়িতাগণ আধুনিক কালের বড় বড় লেখকগণ থেকে কম খ্যাত নন। বরং অনেক লোক-কবিই আছেন যাদের সংগে কারও তুলনাই হয়না তাঁর নিজস্ব প্রতিভার নিকট । আজ আমরা এমনই এক লোক কবির সম্বন্ধে আলোচনা করবো যার কীর্তিগাথা ‘পল্লী-সাহিত্যে’ চণ্ডীদাস, বৈষ্ণব সাহিত্যে’ বিদ্যাপতি অপেক্ষা দান কম নয় ।
ইতিহাস ভাগ
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ছায়া-ঢাকা, পাখি-ডাকা এই নৈসর্গিক সমৃদ্ধশালী নদী মাতৃক বাংলায় দেখা দিয়েছে বহু জাতির উত্থান ও পতন। বিদেশিরা এর অতুল ঐশ্বর্যের লোভে ব্যবসা উপলক্ষে এসে এদেশের সহজ-সরল-বিশ্বাসপ্রবন জন সাধারণের সরলতার সদ্ব্যবহার করেছে। তারা বিভিন্ন রকমের কৌশলের সাহায্যে এদেশকে শোষণ করে লুট করেছে এর ধন সম্পদ, ইতিহাস ও কৃষ্টি।
এসব বিদেশিদের মধ্যে উচ্চাভিলাষী, সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থান্বেষী ইংরেজ জাতি এদেশে ব্যবসা থেকে শাসন এবং শাসন থেকে শোষণের জন্য বিশেষ ভাবে সুপরিচিত। বিখ্যাত ‘দ্যা ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থের লেখক মি. উইলিয়াম হান্টার সাহেব মুসলমানদের যথেষ্ট দোষারোপ করা সত্ত্বেও একথা স্বীকার না করে পারেন নি যে, “এখানকার (বাংলার) মুসলমান অধিবাসীরাই বৃটিশ শাসনে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। …………. ১৭০ বছর আগে বাংলার কোন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান গরিব হয়ে পড়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু বর্তমানে তার পক্ষে ধনী হয়ে পড়াটাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে ।
প্রকৃতপক্ষে “ইংরেজরা ভারতীয় হিন্দু ও হিন্দু জমিদারদের সহযোগিতায় মুসলিমদের হাত থেকে শাসনভার কেড়ে নেয়” । ফলে ভারতীয় হিন্দু ও ব্রিটিশরাজ শক্তি কর্তৃক মুসলমানরা নানাভাবে বঞ্চিত ও অত্যাচারিত হতে থাকে । কারণ, “বৃটিশরা মুসলমানদের বিপদজনক বলে মনে করতো। এই অত্যাচারের চরম পরিণতি দেখা দেয় কুখ্যাত নীল চাষ শুরু হবার ফলে ।
নীল চাষ করার অজুহাতে যথেচ্ছ ভাবে অমানুষিক অত্যাচার ভারতীয়দের উপর বিশেষ করে মুসলমানদের উপর নির্মমভাবে চালানো হয়েছে। এ সম্পর্কে ড. উইলিয়াম কেরী বলেন, “এই কোম্পানি ব্যবসা বাণিজ্য করতে এসে ছলে-বলে ও কৌশলে বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মালিক হয়েছিল এবং স্বপ্ন দেখেছিল সমগ্র ভারতকে জয় করবার।
এই উদ্দেশ্যে কোম্পানির কর্মীগণ ও নেতৃবৃন্দ যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত ছিল এবং তাদের নৈতিক জীবনও অত্যন্ত হীন ছিল”। ইংরেজ প্রভুত্বের বহু পূর্ব থেকেই তারা এদেশে নীল চাষ শুরু করে। যদিও ১৮৭৭ সালে সরকারিভাবে প্রথম নীলকুঠি স্থাপিত হয়। (ইংরেজগণের) বাংলা জয়ের বহু পূর্বেই বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে মাদ্রাজ, কলিকাতা ও ঢাকার বাণিজ্যিক অঞ্চল সমুহে বে-সরকারিভাবে নীল চাষের প্রবর্তন ও নীলকুঠি স্থাপিত হয়।
এ দেশের উৎকৃষ্ট নীল উৎপাদনই জনগণের কাছে ভয়াল মূর্তি নিয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গভারত জবরদস্তি দখলের সংগে সংগে নীলচাষও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশে বাংলার নীলের চাহিদা ছিল প্রচুর। তন্মধ্যে “যশোর ও নদীয়ার উৎকৃষ্ট নীল পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে”। বৃহত্তর যশোর জেলার মধ্যে ঝিনাইদহ ছিল এক আশ্চর্য নীল সমৃদ্ধ অঞ্চল।

এখানকার উৎকৃষ্ট নীল বিদেশিদের মোহগ্রস্থ করে তোলে। ফলে, অধিক মুনাফার লোভে এই মহাকুমা ছিল সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত। এ কারণেই নীল বিদ্রোহ সর্বপ্রথম যেসব অঞ্চলে দেখা যায় ঝিনাইদহ ছিল তাদের অন্যতম। আপামর জনসাধারণ এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ করে। সাহিত্যিকরাও পিছিয়ে ছিলেন না। ‘নীল দর্পন’ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ ।
ঝিনাইদহ জেলাতে বহু নীলকুঠি স্থাপিত হয়েছিল। তন্মধ্যে হাজরাপুর, মধুপুর, পোড়াহাটি, নারায়নপুর, হরিশপুর, নগরবাথান, বাড়িবাথান, গোপীনাথপুর, সোহাগপুর, ঘোলদাড়ি, শৈলকুপা, বরিশাট, জিতোড়, রাজারামপুর, ভুয়াডাঙ্গা, কাতলামারী, দূর্গাপুর, দুদসর, জোড়াদাহ প্রভৃতি গ্রামের প্রধান ঘাঁটিগুলো ছিল উল্লেখযোগ্য ।
“এছাড়া মথুরাপুরের বকশী, পবহাটির মজুমদার, সাধুহাটির আচার্য, তালখড়ির ভট্টাচার্য, নলডাংগার রাজা, ভগবান নগরের রায়, হাটবাড়িয়ার জমিদার, শ্রীধরপুরের ঈশ্বর চন্দ্র বসু, নারিকেলবাড়িয়ার সাধু খা প্রভৃতি জমিদার ও তালুকদারদেরও বিভিন্ন স্থানে নীল কুঠি ছিল” । এদের মধ্যে মধুপুর কনসার্ন এর চিত্র ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। শেরীফ সাহেব ছিলেন এখানকার অধিকর্তা। অন্যায় অত্যাচারের জন্য তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। শেরীফ সাহেবের সম্বন্ধে কবির গানে বর্ণনা আছে।
তৎকালে এত বেশি নীলকুঠি স্থাপিত হয়েছিল যে, প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এর সন্ধান মিলতো। এসব নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান । যার ফলে, “কুঠিয়ালদের মধ্যে জমির এলাকা ও প্রজা বিলি নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া ফ্যাসাদ লেগেই থাকতো। ফলে, কুঠিয়ালদের আর যাই হোক না কেন প্রজাদের দুঃখ দুর্দশার অন্ত থাকতো না ।
পূর্বেই বলেছি ঝিনাইদহ জেলা উৎকৃষ্ট নীল উৎপাদনকারী অঞ্চল হওয়ায় অত্যাচারের মাত্রাও এখানে ছিল বেশি। এদের অত্যাচারের ফলশ্রুতিতে দেখা যেত বহু লোক বাস্তুভিটার মায়া ত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে বেঁচেছে বা আত্মহত্যা করেছে। তবুও অত্যাচারের মাত্রা কমেনি বরং দিনের পর দিন একের পর এক অভিনব পন্থায় অত্যাচার, অনাচার ও অবিচার চলেছে নিরিহ জনগণের উপর ।

শুধু তাই নয় প্রজাদের উৎকৃষ্ট শ্রেণির জমিতে নীল বোনার আদেশ, খেজুর গাছের মত মূল্যবান সম্পদ কেটে ফেলা, পলাতক বা বিদ্রোহী প্রজাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বাস্তুভিটায় নীল চাষ, বিনা পয়সায় গরু-ছাগল-মুরগী প্রভৃতি ধরে নিয়ে যাওয়া, প্রজাদের স্ত্রী-কন্যাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা ছিল কুখ্যাত ইংরেজ কুঠিয়ালদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য । এমনি এক অত্যাচারিত মধ্যবিত্ত পরিবার ঝিনাইদহের নগরবাথান কনসার্নাধীন মাধবপুর থেকে বেড়বাড়ি পালিয়ে এসে জীবন রক্ষা করেন । নাম কুড়োন শেখ ।
আরও দেখুনঃ
