জালাল উদ্দিন খাঁ ব্রিটিশ ভারতের নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে ১৮৯৪ সালে ২৫ এপ্রিল তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সদরুদ্দীন খাঁ। বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক অবধি প্রাকৃত বাঙালিজনের এই গীতিকবি তার সাধনায় সক্রিয় ছিলেন।
আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বের নামাঙ্কিতের মাঝে জালাল উদ্দিন প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেছিলেন। প্রখ্যাত এই লোক কবি মালজোড়া গানের আসরেও ছিলেন অনন্য। জালাল উদ্দীন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন।
জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন ‘তত্ত্ব’তে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নামগুলো হলো- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ় তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। ‘জালালগীতিকা’র অধিকাংশ গানই এরকম তত্ত্বনামাঙ্কিত হলেও অনেক গানকে জালাল খাঁ তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
যেমন- ‘জালাল গীতিকা’ প্রথম খণ্ডে সংকলিত ২০২টি গানের মধ্যে ২০টি গান ‘ভাটিয়ালি’ নামাঙ্কিত। দ্বিতীয় খণ্ডের ২২৮টি গানের ৬০টিই ‘ভাটিয়ালি’। তৃতীয় খণ্ডের ৭৮টি গানের সাতটি ‘তত্ত্ব’ বিষয়ে, আর ১৪টি ‘মুর্শিদি’ ও ১১টি ‘মারফতি’ নামাঙ্কিত গান।
‘জালাল গীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো তত্ত্ব নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের হতে ‘জালাল গীতিকা’র যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস বা নামাঙ্কন করা হয়নি। নব এই প্রকাশনায় জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতি সংকলন করা হয়। তাছাড়া ” বিশ্ব রহস্য ” নামে একটি প্রবন্ধ গ্রন্হ প্রকাশ করেন।
১৯৭২ সনে ৩১ জুলাই বাংলা ১৬ই শ্রাবণ, ১৩৭৯ দুই পুত্র তিন কন্যা, এবং স্ত্রী শামছুন্নাহার বেগমকে রেখে দেহত্যাগ করেন। নিজ গ্রামের বাড়ীর আঙ্গিনায় তার মাজার অবস্থিত। প্রয়াত মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ স্মরণে প্রতি বছর দু’দিন ব্যাপী পালিত হয় জালাল মেলা।

Table of Contents
জালাল উদ্দিন খাঁর গান :
জালাল উদ্দিন খাঁর জীবদ্দশায় চার খণ্ডের ‘জালাল-গীতিকা’ গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড। সেই খণ্ডে গানের সংখ্যা ৭২টি। এই মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে ‘জালাল গীতিকা সমগ্র।’
আসুন দেখে নেই তার গানের সম্ভার:
দিন গেলে আর দিন আসে না
দিন গেলে আর দিন আসে না
ভাটা যদি লয় যৈবন
থাকতে ক্ষুধা প্রেম শুধা
পান করো রে পাগলা মন
হায়রে পান করো রে পাগলা মন
থাকতে ক্ষুধা প্রেম শুধা ।।
আসমানে জমিনে যে প্রেম অনন্তকাল ধরিয়া।
তাই তো তারে মেঘ বাদলে রাখে শান্ত করিয়া।
তা না হলে হলে হুলে। (হায়রে) শোভিত না (খোদার) এই ভুবন
থাকতে ক্ষুধা প্রেম শুধা
পান করো রে পাগলা মন
পাহাড়ে সাই ঘুরে যে প্রেম ফাটাইয়াছে এক সাথে।
তাই তো পানি বাস্প হইয়া উঠে গিয়া তার মাঝে।
দেখছ নি তাই মন ভাবিয়া। হইতেছে কত পরেশন
থাকতে ক্ষুধা প্রেম শুধা
পান করো রে পাগলা মন
খোদার প্রেমে জংগলবাসী মনি ঋষি আওলিয়া (আওলিয়া…)।
সারা জনম কাটায় তারা গাছতলাতে বসিয়া
পাইলো কী ধন কইলো না রে
পাইলো কী ধন কইলো না তাই (সদাই) কান্দেরে জালালের মন
থাকতে ক্ষুধা প্রেম শুধা
পান করো রে পাগলা মন।।
মন জানে আর কেউ জানে না
আমায় যত দুঃখ দিলা বন্ধুরে
আমার মাইট্টা দেহ কুলায় নারে কুলায় নারে কুলায় না
মন জানে আর কেউ জানে না
মন জানে আর কেউ জানে না
সোনা বন্ধুরে মন জানে আর কেউ জানে না।
ও বন্ধুরে আরে কাষ্ঠে লোহায় পিড়িত করে নৌকাটা ভাসিয়া চলে
দোহে মিলে যুক্তি করে শুকনায় রইলো না, তারা শুকনায় রইলো না
জলের বুকে ভাইসা বেড়ায় গো বন্ধু জলের বুকে ভাইসা বেড়ায় গো
বন্ধু তারার পিড়িত ভাঙ্গে নারে ভাঙ্গে নারে ভাঙ্গে না
মন জানে আর কেউ জানে না।
সোনা বন্ধুরে মন জানে আর কেউ জানে না
ও বন্ধুরে তোমায় পাইবো পাইবো পাইবো আশে
ইহজীবন জীবন গেল্ বিফলে প্রেমের রশি দিয়া গলায় হইলো কি লাঞ্ছনা
আমার হইলো কি লাঞ্ছনা
কলিজা হইয়াছে অঙ্গারে কলিজা হইয়াছে ছিদ্ররে
বন্ধু ধরলো ঘূণে ছাড়ালো নারে ছাড়ালো নারে ছাড়ালো নারে
মন জানে আর কেউ জানে না।
সোনা বন্ধুরে মন জানে আর কেউ জানে না
ও বন্ধুরে ওরে আর জানে জহুরী যারা
বেলা শিক্ষা গলায় দিয়া সোনার পাছায় সু আকা
তার লাগিরে ফানা বন্ধু তার জন্যে যে ফানা
যার জন্যে যার ভালবাসা রে বন্ধু যার সনে যার ভালবাসা রে
বন্ধু ব্যবহারে যায় চিনারে যায় চিনারে যায় চিনা
মন জানে আর কেউ জানে না।
সোনা বন্ধুরে মন জানে আর কেউ জানে না
ও বন্ধুরে আমায় কান্দাইলি এই ভবে ভাসাইলাম আল্লাহুতের নদী
এ জমন কাইন্দা আমি তোমায় পাইলাম না বন্ধু তোমায় পাইলাম না
জালালে চায় মনের মানুষরে বন্ধু জালালে চায় মনের মানুষরে
বন্ধু যার কোন নাই তুলনা রে তুলনা রে তুলনা রে
মন জানে আর কেউ জানে না।
সোনা বন্ধুরে মন জানে আর কেউ জানে না।।
ভালবাসি বলে রে বন্ধু
থাকতে যদি না পাই তোমায়
চাইনা মরিলে
আমায় কাঁদালে
ভাল বাসি বলে রে বন্ধু
আমায় কাঁদালে রে বন্ধু
তাই বুঝি আজ বুক ভেসে যায়
নয়নের জলে
আমায় কাদালে
ভালবাসা করে যে জন
কাঁদিতে হয় অতি গোপন ।।
শুস্ক বৃক্ষের কষ্ট যেমন
পাতা নাই ডালে
আমায় কাঁদাল………
ভালবাসা এমন রীতি
কাঁদিতে হয় দিবা নিশি ।।
তবু আমি মালা গাঁথি
পরেছি গলে
আমায় কাঁদালে
ভালবাসি বলে বন্ধু
আরও দেখুন: