বাউল সাধকগণ – বাউল শিল্পী বা বাউল সাধক বা বাউল একটি বিশেষ ধরনের গোষ্ঠী ও লোকাচার সঙ্গীত পরিবেশক, যারা গানের সাথে সাথে সুফিবাদ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি মতাদর্শ প্রচার করে থাকে। বাউল সাধক বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। মূলত বাউল সংগীত একধরনের বাংলা সুফিবাদ সংগীত ছিল।
বাউল গান পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ্য করা গেলেও মূলত কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নিকট। বাউলদের সাদামাটা জীবন ধারণ ও একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউলদের বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

Table of Contents
বাউল সাধকগণ
এক
বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বজনীন দিকসমূহ গ্রহণ এবং অনুদার বা সংকীর্ণ দিক সমূহ পরিহার পূর্বক ষোড়শ শতকে সাধারণ সমাজে সর্বজন গ্রাহ্য যে মহামানব ধর্মের উৎপত্তি ঘটে তা-ই বাউল। বাউল ধর্মের আচার-আচরণ নাথ ও বৌদ্ধ সহজিয়া দ্বারা প্রভাবিত হলেও দর্শনে সুফি ও চৈতন্য মতবাদের প্রভাব অধিক। এমনকি বাউলদের সঙ্গীতেও সুফি ও চৈতন্যের প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
উল্লেখ্য সুফি সাধকগণ জিপসি, ডবকি, শিঙ্গা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীত পরিবেশন পূর্বক স্রষ্টার ধ্যানে মগ্ন হতেন। তারা যে সঙ্গীতের সাহায্যে ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হতেন তার নাম সামা। খানিকটা দ্রুত লয়ের এই গানের সঙ্গে বৈষ্ণবদের মধ্যম লয়ের পদাবলীর মিশ্রণে পরবর্তীকালে উদ্ভব ঘটে বাউলের মতো সঙ্গীতের।
বাউল শব্দের অর্থ এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, ক্ষ্যাপা প্রভৃতি।১ বাউল সাধকগণ সাধারণ মানুষের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে জীবন যাপন ও ধর্মচর্চা করতেন বিধায় জনগণ এদের বাউল বলে আখ্যায়িত করেছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য বাউলগণ নিজেরাও নিজেদের বাউল বা পাগল হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন। এমনকি এ যুগের বাউলগণও নিজেদের গানের ভনিতায় বাউল, পাগল, পাগলা প্রভৃতি শব্দ করছেন ব্যবহার। বাউল শব্দের প্রয়োগ বহুপূর্বকাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। কিন্তু চৈতন্যের জন্মের পূর্বে মতবাদ বা গোষ্ঠী অর্থে এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় না।
চৈতন্যের পূর্বে ওই নামে কোনো গোষ্ঠী, দল বা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না বলেই এমনটি হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। চৈতন্যের নববৈষ্ণব মতবাদের প্রভাবে সুফি ও নাথ প্রভাবিত কয়েকটি ক্ষুদ্র দল একত্রে একটি বৃহৎ সম্প্রদায়ে পরিণত হলে জন সাধারণ এদের বাউল সম্প্রদায় নামে আখ্যায়িত করে।২ অবশ্য এই মত বা সম্প্রদায়ের উদ্ভবকাল বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।
কোনো কোনো পণ্ডিত চৈতন্যের জন্মের পূর্বেই বাউল মতের উদ্ভব বলে ধারণা করেন।৩ তাঁদের মতে নাথ, বৈষ্ণব ও সুফি মতের প্রভাবে ষোড়শ শতকের পূর্বেই বাউল মতের সৃষ্টি। পক্ষান্তরে চৈতন্যের পরে যাঁরা এই মতের উদ্ভব বলে মনে করেন তাঁদের মতে, নাথ, সুফি ও নব্যবৈষ্ণব মতের সংমিশ্রণে ষোড়শ শতক-এর উৎপত্তি।৪
আমরা বাংলাদেশে প্রচলিত বাউলসঙ্গীতের ভাষা, বক্তব্য এবং এর রচয়িতাদের জীবনকাল পর্যালোচনা করে চৈতন্যের জন্মের পরই এই মতের উদ্ভব বলে মনে করি। উল্লেখ্য, চৈতন্যের জন্মের পূর্বে মতবাদ বা গোষ্ঠী অর্থে যেমন বাউল শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় না; তেমনি সুফি ও চৈতন্যের মতবাদের সম্মিলিত প্রভাবিত স্থান ব্যতীত উৎকৃষ্টমানের বাউলসঙ্গীতও পরিলক্ষিত হয় না। কুষ্টিয়া ও সিলেট একই সঙ্গে সুফি ও বৈষ্ণব প্রভাবিত অঞ্চল ছিল বিধায় এতদঞ্চল সংখ্যা ও মানের দিক থেকে সুসমৃদ্ধ বাউলসঙ্গীত সৃষ্টিতে হয় সক্ষম।
লালন, হাসনের মতো প্রতিভাবান কবিদের অবদানের কথাও অবশ্য এক্ষেত্রে উপেক্ষণীয় নয় মোটেও। বিভিন্ন ধরনের শাস্ত্র যেহেতু বিভিন্নভাবে স্রষ্টার আরাধনা করার পরামর্শ প্রদান করেছে এবং যেহেতু এ নিয়েই মানুষের মধ্যে যতো বিভেদ, হানাহানি; তাই বাউলদের প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহ ছিল শাস্ত্রাচারের বিরুদ্ধে।
শাস্ত্র ও আচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁরা দেহতত্ত্ব বিষয়ে সাধন-ভজন করেছেন। অবশ্য সুফি ও বৈষ্ণবদের মতোই যদিও তাঁরা বলেছেন, দেহের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব, তথাপি সুফি ও বৈষ্ণব থেকে তারা ছিলেন পৃথক। সুফিদের ইসলাম প্রভাবিত আচার আর বৈষ্ণবদের হিন্দু প্রভাবিত কর্ম পরিত্যাগ করে তারা কেবল সঙ্গীতের মাধ্যমেই স্রষ্টার আরাধনায় হন ব্যস্ত। এ প্রসঙ্গে দুদ্দু শাহ বলেন-

বাউল বৈষ্ণব ধর্ম এক নহে ভাই
বাউল ধর্মের সাথে বৈষ্ণবদের যোগ নাই।
বিশেষ সম্প্রদায় বৈষ্ণব
পঞ্চ তত্ত্বে করে জপ তপ
তুলসী মালা অনুষ্ঠান সদাই।
বাউল মানুষ ভজে,
যেখানে নিত্য বিরাজে,
বস্তুর অমৃত মজে নারী সঙ্গী তাই।
(অংশ বিশেষ)
এ সময়ের আলোচিত ব্যক্তিত্ব সাইদুর রহমান বয়াতি বলেন ‘গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বলেছেন-জীবে দয়া, স্বার্থত্যাগ, ভক্তি নারায়ণে-সুফিরাও বলেন-অহিংসা পরম ধর্ম, হিংসা করা মহাপাপ। বৈষ্ণবদের সঙ্গে তাই সুফিদের সম্পূর্ণ মিল। বাউলদের সঙ্গে সুফিদের মিল আছে। তবে একটু তফাৎও আছে। তফাৎ হলো ইনাদের ইচ্ছা স্বাধীন সন্তানাদি জন্ম দেয়া এবং খাওয়া খাদ্দির ব্যাপারে। ‘৫ লালন শাহ এক্ষেত্রে বলেন-
“আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
ওরে তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পথে পথে মদিনা।”
(অংশ বিশেষ)
এই কথার প্রতিধ্বনি আমরা পরবর্তী বাউল কবিদের গানেও প্রত্যক্ষ করি। দুদ্দু শাহ এক্ষেত্রে বলেন-
“কে তাহারে চিনিতে পারে ভাই
মানুষের চরণ না চিনিলে উপায় নাই ।
কাশী কিংবা মক্কায় যাও রে মন
দেখতে পাবে মানুষের বদন
ধ্যান ধারণা ভজন পূজন মানুষ নিধি সর্ব ঠাঁই।
মানুষের আকার ধরে
খোদা যে ঘুরে ফেরে
যবন কাফের বলে কারে দিলে গো তাড়াই।
দেখিয়া মানুষের দশা
দুদ্দুর মুখে নাই গো ভাষা
মনেতে করি গো আশা একদিন জানবে সবাই।”
কখনো কখনো অবশ্য তারা অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্যও উপস্থাপন করেছেন। অন্যমত ও পথের যাত্রী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার কারণেও তারা এমন বক্তব্য উপস্থাপন করে থাকতে পারেন। যেমন-
১.
“সত্য বলে জেনে নাও, এই মানুষ লীলা।
ছেড়ে দাও নেংটি পরে হরি হরি বলা
মানুষের লীলা সব ঠাঁই
এ জগতের তুলনা নাই।
প্রমাণ আছে সর্বদাই ।
যে করে সে খেলা
শাস্ত্র তীর্থ ধর্ম আদি
সকলের মূল মানুষ নিধি
তার উপরে নাইরে বিধি।
ভজন-পূজন জপমালা।
মানুষ ভজনের উপায়
দীনের অধীন দুদ্দু গায়
দিয়ে দরবেশ লালন সাঁইর দায়
সাঙ্গ করিয়ে পালা।”
২.
এদেশের মুসলমান বড়াই করে
আমরা বাদশাই জাতির খান্দানরে।
সহস্র বৎসর পূর্বে ভাই
মুসলমানের গন্ধ দেখি নাই।
যত অনার্য শুদ্র ওরাই
ধর্ম ভারত হয় রে।
করে চৌকিদারী পেয়াদাগিরী
দ্বারে দ্বারে ফেরে ঘুরি
দুদ্দু তাই তো কয় ফুকারি,
বড়াই ভাল নহে রে ॥”
অবশ্য প্রচলিত ধর্মাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই যেহেতু তাদের সৃষ্টি; সেহেতু সেসব মত ও পথের বিরুদ্ধে তো তারা কিছুটা কঠোর হবেনই। বাউল জালাল উদ্দিন তাই বলেন-
দরবেশ তুমি আল্লাহ খোঁজ
ঋষি খোঁজ ভগবান।
হয় না দেখছি কারো সাধ্য
করিতে তার অনুসন্ধান।।
ছিড়া ক্যাঁথা লেংটি ঝাঁটা
ঊর্ধ্ব অঙ্গে দীর্ঘ ফোঁটা।
মিছে সব ফন্দি আটা
সাড় করিল বন শশ্মান।।
ভগবান সে নয় জানোয়ার
কি দেখা পাবো গো তার
পাইল পাইবে স্বরূপ সাকার
যে রূপ আছে বর্তমান।।
(অংশ বিশেষ)
তবে এঁরা যে নিরীশ্বরবাদী নন; এর প্রমাণও রয়েছে তাঁদেরই গানে। দুদ্দু শাহ বলেছেন-
“চার যুগের উপর কে দেয় খেয়া
তাহারে চিনিয়া ধর ও মন ভাড়া।
শুক্রবিন্দু হয়ে যখন করেছিলে যোনিভ্রমণ
কে তোমায় করিল ধারণ দয়াল হইয়া।
তোমার মত কত জন রে
বিনা যোগে গেছে মরে
কৃপা করে তোমায় ধরে রাখে জীবন দিয়া।
সেইজন ভজনের গোড়া
হোসনে তার চরণ ছাড়া
দুদ্দু কয় মোর মন বেয়ারা, বেড়ায় তীর্থে হাটিয়া।”
তাঁদের ঈশ্বর দর্শনে মূলত বৈদিক, বৈষ্ণব ও সুফি মতেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়-
বাউল জালাল বলছেন-
গো স্বামী বল আমার কোথায় রাখি পা
বাড়াই চরণ শিউড়ে উঠি দেইখ্যা তোমার গা।।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড মাঝে সেজেছিস তুই কতই সাজে
সবখানেতে তোরেই দেখি যেখানেতে আছে যা।।
দেহের গোমান কইরা মরি কিছুই তাতে নাই আমরারই
ছায়াবাজির ছায়া শুধু এ ছাড়া আর কিছুই না।।
আমি শুধু নামে নামী তুমিই যে সব কামের কামী
মাঝখানেতে হই বদনামী কুলির বাসায় কাকের ছা।।
পঞ্চভূতে দিয়া বেড়া আমার মাঝেই তোর চেহারা
লুকি দিয়া দেহের খাচায় জালাল নামে করিস রা।।
কবি মকদ্দস উদাস বলেন-
খোদার নাই মুণ্ডু মাথা
নাই চক্ষু কর্ণ নাসিকা
শুনবে বল কে কার কথা।
নাই তার পিতা নাই তার মাতা
কারও সনে নাই আত্মীয়তা
নাই তার স্ত্রী পুত্র ভ্রাতা
কে তারে করে মান্যতা।
কেউ বলে ওয়াজিবুল অযুদ
নিজে নিজের হয়ে মওদুদ
লিং বিহীন খোদিনা খুদ
মিছামিছি এসব চিন্তা।
রং ছুরত তার জানলে বল
নীল সাদা না সবুজ কালো
জল পান না আঁধার আলো
না দেখলে কি হয় সত্যতা ॥
নাই পেলে নাই তার সমাধান
কে শুনিবে কার বয়ান
মকদ্দস কয় পাইলে প্রমাণ
না পেলে নাই সত্য মিথ্যা ॥”
একই সঙ্গে অবশ্য বিভিন্ন মতের সমন্বয়ের পক্ষেও তাঁরা কথা বলেন-
১.
“নারী ভজনের গোড়া তন্ত্রের নিরূপণ
যুবতী দর্শন মাঝে কালিকা দর্শন; ভবেৎ
শিবের বচন।
দোষে সেই পরম শক্তি
কোথা গিয়ে পাবে মুক্তি
পলকে ঘটে সিদ্ধি সেধে সে চরণ।
মনগড়া আইন ছুঁড়ে
বনে বনে বেড়াও ঘুরে
হাতের কাছে মিলতে পারে পরম রতন।
জেনে শুনে ভজো নারী
হয়ে যাবে নির্বিকারী
দীন দুদ্দু কয় ফকির লালন সাঁইর বচন।
২.
“কোন কৃষ্ণ হয় জগৎ পতি
মথুরার কৃষ্ণ নয় সে সে কৃষ্ণ হয় প্রকৃতি।
জীবদেহে শুক্র রূপে এ ব্রহ্মাণ্ডে আছে ব্যাপে
কৃষ্ণ তারে কয় পুরুষ যেই হয় সেই রাধার গতি।
কৃষ্ণ বস্তু নিগম করে জীব দেহে বিরাজ করে
রসিকের করণ সে কৃষ্ণ মরণ করে গম্ভীর অতি।
আত্মতত্ত্ব জানে যে জন
কৃষ্ণ সেতু-চেনে সে জন
লালন সাঁইর বাণী রসিক ধনী বলে দুদ্দুর প্রতি।”
(‘নিজস্ব সংগ্রহ’)
৩.
“নারায়ণ অমৃত সুধা
প্রেম ভাণ্ডে লক্ষ্মী সার
মন আমার গুরু রূপে
চতুর দলে দরশন ও তিনার ।
পাবে ত্রিনাথের কুল
কলিতে মেষ ও ব্রহ্ম
নাসিকায় তার বুল।
না চিনিলে রসাতলে
চিনলে ঘুছে অন্ধকার ॥
তিনি অনাদি ব্রহ্ম
বিষ্ণুদেব পালন কর্তা
ব্রহ্মা দেন জন্ম।
রজগুণে সর্বসূশিষ্ট মহাদেব করেন সংহার।
ফকির তাজুদে বলে
মুর্খ হইয়া জন্ম নিলাম ভূ-মণ্ডলে।
কবে যাব ভূ-মা কোলে
অপেক্ষায় আছি তাহার ।”
-(পীর তাজুদ আলী)
8.
“ধর্ম কি জাত বিচারে
যোগী ঋষি মহাজন সবাই দেখে সমান করে।
করিম-রহিম-রাধা-কালী এ বুল সে বুল যতই বলি
শব্দভেদে ঠেলাঠেলি হইতেছি সংসারে।
মানব-দেহে থেকে স্বয়ং একই শক্তি ধরে
প্রেমের মূর্তি-লয়ে একজন বিরাজ করে প্রতি ঘরে।
ক্ষিতি-জল-বায়ু-বহ্নি আগুন মাটি হওয়া-পানি
এক ভিন্ন আর নাহি জানি যা আছে সংসারে।
করিম কৃষ্ণ হরি হযরত লীলার ছলে ঘুরে
ভাবে ডুবে খুঁজে দেখ ভেদাভেদ কিছু নাইরে।
হিন্দু কিংবা মুসলমান শাক্ত বৌদ্ধ খিশ্চিয়ান
বিধির কাছে সবাই সমান পাপ পূণ্যের বিচারে
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড-সাঁই লক্ষ আকার ধরে-
মাটি দিয়ে কুম্ভকারে পুতুল পাতিল কতই গড়ে।
জালাল পাগলার কথা ধর আত্মসমর্পণ করে
দলাদলির ভাবটি ছাড় বলি বিনয় করে
করো না দু’দিনের বড়াই সং সেজে সংসারে
এক হাতের তৈয়ারী জীব আসা যাওয়া এক বাজারে।”
৫.
নিগূঢ় লীলা রসিক জানে
সে যে অধিকারী হয় ভজনে।
অবতারে হয় কাণ্ডারী জীবের নিস্তার কারণে।
দয়া কর নিমাই রূপী।
আর আছে হযরত নবী
নিমাই হযরত একে ভিন্ন ছবি
সাই একা একেশ্বর।
কাহে হিন্দু কাহে মুসলমান
মিলজল হও মন, সাঁই-সেবনে।
কেহ পুরুষ, কেহ প্রকৃতি
সর্বমধে সাঁই এর বসতি
করছে খেলা রস রতি
দেখি জগৎময় ।
এক দিকে হয় ব্রহ্মার সৃষ্টি।
এক দিকে প্রেম সাধু জানে।
গুরু দেহে কারো স্থিতি
যদি হয় মন নিষ্ঠারতি;
শুদ্ধ ভক্তি অহৈতুকী
মৃঢ় পাঞ্জর ঘটবে কোনে।”
-(পাণ্ডুশাহ)
অবশ্য ঘুরে ফিরে মানুষই সবচেয়ে বড় হয়ে সম্মুখে দাঁড়ায়। মানুষকে কষ্ট দিয়ে নারীকে অবহেলা করে যে ধর্ম হয় না। -এ কথাই ঘুরে ফিরে তাঁদের বক্তব্যে ওঠে আসে। বাউলরা নিজেদের জীবাত্মা রূপে কল্পনা করে দেহের মধ্যেই পরমাত্মার অস্তিত্ব অনুভব করেন। তাঁদের অধ্যাত্ম সাধনার বিরাট একটা অংশ জুড়ে আছে তাই দেহ। দেহকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের গানও তারা সৃষ্টি করেছেন।
ক.
“ও বারই কই লুকাইলায়রে
ঘরখানা বানাইয়া বারই
কই লুকাইলায় রে।
হাসন রাজা ঘরে বাইরে
তুকাইলরে ।
-হাসন রাজা
খ.
মাটির পিঞ্জিরায় মাঝে
বন্দি হইয়া রে
কান্দে হাসান রাজার
মন মনিয়ারে ।
-হাসন রাজা
অবশ্য কেবল ঘর আর পিঞ্জিরাই নয়; গাড়ি, ঘড়ি, নৌকা, জাহাজ এমনকি কল- কারখানাও দেহের প্রতীকরূপে এসব গানে হয়েছে উদ্ধৃত। যেমন-
১.
গাড়ি
“গাড়ি
চলেনা চলেনা চলেনা রে
গাড়ি চলেনা।
বানাইয়া মানব গাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্যখানে ঠেকলো গাড়ি
উপায় বুঝি মেলেনা।”
-বাউল আব্দুল করিম
২.
ঘড়ি
“মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
বানাইয়াছে কোন মেস্তরি
একখান চাবি মাইরা দিলে ছাইড়া
দিনে রাইতে চলতে থাকে।”
-আব্দুর রহমান বয়াতি
৩.
“আজব এক জাহাজ গড়ে
দীনবন্ধু পাঠাইছেন ভবের পরে
সে জাহাজ পানিতে কখন চলেনা
শুকনাতে ভেসে ফেরে
দীনবন্ধু জয়সিন্ধু মন মাঝি হাল ধরে
জাহাজ চলত্যাছে তাই দুই দাঁড়ে।”
-পাগলা কানাই
8.
খাঁচা
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়।
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়।”
-লালন শাহ
৫.
নৌকা
“আমার দেহতরী কে করলো গঠন
মেস্তরি কে চিননি রে মন।
ঐ যে গুড়া আছে ছোটো বড় সব দিয়াছে
কে কৈল গঠন গো নায়ের কে কৈল গঠন
লুআ ছাড়া তক্তার জোড়া বেশ করিয়াছে পাটাতন ।”
-রাধারমণ
৬.
অন্যান্য
নিশিতে যাইও ফুল বনেরে ভমরা
নিশিতে যাইও ফুল বনে।
নয় দরজা করি বন্ধ
লইও ফুলের গন্ধ রে ভমরা… ।
জ্বালাইও দিলের বাত্তি
ফুটিব ফুল নানা জাতি
কত রঙে ধরবো ফুলের কল্লি রে ভ্রমরা।
জল-পাতা-বৃক্ষ নাই
এমন ফুল ফুটাইছে সাঁই
ভাবুক ছাড়া বুঝবে না পণ্ডিতরে ভ্রমরা ।
অধীন শেখ ভানু বলে
ঢেউ খেলাইও আপন দিলে।
পদ্ম যেমন ভাসে গঙ্গার জলেরে ভমরা ।”
শেখ ভানু
৭.
“দেহের খবর বলি শোনরে মন
দেহের উত্তর দিকে আছে বেশী
দক্ষিণেতে আছে কম ।
দেহের খবর না জানিলে
আত্মতত্ত্ব কিসে মিলে
লাল জরদ মিয়া সফেদ
বাহান্ন বাজার এই চারিকোন ॥
আগে খুঁজে ধর তারে
নাসিকাতে চলে ফেরে
নাভি পথের মূল দুয়ারে
বসে আছে সর্বক্ষণ ॥
আঠারো মোকামে মানুষ
যে না জানে সেই তো বেহুস
লালন বলে, থাকবে হুস
আদ্য মোকামে তার আসন ।”
-লালন শাহ
বাউলদের একটা অংশ বৈষ্ণবদের মতোই ছিলেন সংসার ও নারী সঙ্গী বিরোধী। ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের জন্য কাম তথা নারীকে বেশ অন্তরায় বলে তারা মনে করতেন। এতদসংক্রান্ত সঙ্গীতও তাই তারা রচনা করেছেন।
শুধু তাই নয়, সুফি ও বৈষ্ণবদের মতো এদের প্রায় সকলেই ছিলেন গৃহত্যাগী। কিন্তু এদেরই একটা অংশ সংসার বিরাগী হলেও নারীসঙ্গ বর্জনকেই সাধনার ক্ষেত্রে অন্তরায় বলে মনে করতেন। তারা ধারণা করতেন; ইন্দ্রিয় ভোগের মধ্য দিয়েই পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে দেহ সাধনা। এঁরা নির্দিষ্ট কোনো পরিবার বা সমাজে আবদ্ধ হতেন না ঠিকই; তবে বিবাহিতের ন্যায় জীবন-যাপন করতেন। তাদের সাধন সঙ্গিনী ছিলেন একাধিক।
তবে নির্দিষ্ট একটি আখড়ায় নির্দিষ্ট একজন সঙ্গিনীকেই তারা সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিন, কয়েকটি মাস বা কয়েকটি বছরের জন্য সাধনসঙ্গী হিসেবে সঙ্গে রাখতেন। তাদের ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানকে সকলে ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে মনে করতেন এবং সকলে মিলে তার লালন-পালন, ভরণ- পোষণের নিতেন ব্যবস্থা। ইন্দ্রিয় সাধনার জন্য কাম উদ্দীপনমূলক সঙ্গীতও তাই তারা সৃষ্টি করেছেন। এমন কি এ-যুগেও এ ধরনের সঙ্গীত নয় দুর্লক্ষ। যেমন-

১.
অত দামি কেমনে হয় মাটির বাসন
আগুন পানি হাওয়া দিল উপরে পরা বসন।
ধাক্কা লাগে গোপন কলে
ভিজিয়া ঐ পিছলা জলে
দুই ভাণ্ড এক হইলে
খুশি হয় মালিকের মন।
কলসীর মাঝে ভরা জল
তার মধ্যে মহাবল।
কোথায় উপর কোথায় তল
চৌরাশি ক্রোশ বৃন্দাবন ।
কয় উদাসী মকদ্দসে
যে জনে বাসন গড়েছে
একদিন তারে পাইনা কাছে
বাসনা রয় অপূরণ ॥
২.
“যে কলের নাম সুগার মিল
দেখবি যদি শীঘ্র আয়
কী আজব কল বসাইল
মানুষের দেহায়।
দেখলে তার রূপের ছটা
আকুল হয় পরাণ,
প্রথম নাভি হতে করে কৌশল
৭২ হাজার দিছে নল
অ্যানী মন্দা জল চলাচল
চলিতেছে সর্বগায় ।
শ্বাস-প্রশ্বাস দুই ফিতার জোরে
ললাটে দুই বাতি জ্বলে
পাঁচ জনায় মাল ধরে ৩২ জন চেপে ধরে।
একজনায় উলট-পালট করে
আরেক জনায় ভিতরে ঢোকায়।
মল বাহির হয় গুহ্য দ্বারে
রস বাহির হয় বিনদ দ্বারে
নিয়া রমণীর বাজারে
কামালে কয় বস্তার বস্তা চিনি ফালায়।
বস্তুত বাউলগণ দেহকে নিয়ে তাঁদের সাধ্যানুযায়ী, নানা পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করেছেন। বিভিন্ন অনুসন্ধান গবেষণার পর দেহকে তারা নানা ভাগে বিভক্তও করেছেন; নামকরণও করেছেন। কিন্তু ফল একই চিত্তকে শুদ্ধ করতে হবে; মনকে পবিত্র করতে হবে- তবেই পাওয়া যাবে ঈশ্বর নামক সর্বশক্তিমানকে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? জপ, তপ, ধ্যান, পূজা, ব্রত? নাকি, নামাজ, রোজা, জিকির জাকাত, হজ? এগুলোতো ঢের হয়েছে আগে। তবে? মুর্শিদ শিষ্যদের দুভাগে বিভক্ত করলেন- একদল ইন্দ্রিয়কে দমন করে নিষ্কাম, আর অন্যদল নারী সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে সকাম সাধনায় রত হবে। দেখা যাক ‘কোন সাধনায় মিলবেরে সেই পরম ধন’।
নিষ্কাম প্রেমের যে উদ্দেশ্যে, সকাম সাধনারও একই উদ্দেশ্য। ইন্দ্রিয়াতীতে উত্তীর্ণ হয়ে শুদ্ধ হওয়া। আর একারনেই পরকীয়া সাধকগণ নিজেদের মধ্যে বহুগামী হলেও সমাজে কামুক হিসেবে পরিচিত হলেন না। সমাজ জীবনে নিষ্কাম সাধকদের ন্যায় তারাও হলেন অত্যন্ত সংযমী সুশৃংখল।
কোন রসে কোন রতির খেলা।
জানতে হয় এই বেলা।
সাড়ে তিন রতি বটে
লেখা হয় শাস্ত্রপাটে
সাধ্যের মূল তিন রস ঘটে
তিনশ ষাট রসের বালা।
জানলে সে রসের মরম
রসিক তারে যায় বলা।
তিন রস সাড়ে তিন রতি
বিভাগে করে স্থিতি
শুরুর ঠাঁই জেনে পাতি
শাসন করে নিরালা।
তার মানব জনম সফল হবে
এড়াতে শমন জ্বালা।
রস রতির নাই বিচক্ষণ
আন্দাজে করি সাধন
কিসে হয় প্রাপ্ত কি ধন
ঘোচেনা মনের ঘোলা।
আমি উজায় কি ভাটেন পড়ি
ত্রিপীনির তীর নালা ।
শুদ্ধ প্রেম রসিক হলে
কস-রতি উজান চলে
ভিয়ানে সদ্য ফলে
অমৃত মিছরি ওলা
লালন বলে, আমার কেবল
শুধুই জল তোলা-ফেলা।
২.
কোন রাগে সে মানুষ আছে মহারসের ধনী।
পমে মধু চন্দ্রে সুধা জোগায় রাত্রদিনি।
সাধক সিদ্ধি প্রবর্ত তিন
রাগ ধরে আছে তিন জন
এ তিন ছাড়া রাগ নিরূপণ
জানলে হয় ভাবিণী ।
মৃণাল গতি রসের মেলা
নব ঘাটে নব ঘেটেলা
দশমে যোগ বারি গোলা
যজ্ঞেশ্বর অযোনি ।
সিরাজ সাঁইর আদেশে লালন
বলছে বাণী শোন রে মাজন
ঘুরতে হবে নাগর দোলন
না জেনে মন বাণী ।

তবে সকাম সাধকরা যে যত্রতত্র অগণিত সন্তান জন্ম দিয়ে যেতেন এমন নয়। সন্তানের জন্মদান অপেক্ষা জন্ম শাসনেই তাদের অধিক উৎসাহিত করা হতো। গুরু নির্দ্বিধায় উজান পথে চলার উপদেশ প্রদান করতেন। মহাশক্তি ভাটিপথে গমন করলে সন্তানের জন্ম অবশ্যম্ভাবী; আর তাই একে উর্ধমুখে নিক্ষেপের মাধ্যমে মহানন্দ উপভোগের পরামর্শ প্রদান করা হতো।
রস, রতি, চন্দ্র-সূর্য,রবি-শশী, গ্রহ, তিথি, কাল, নক্ষত্র, উজান, ভাটি, দরিয়া, রসের নদী, সিন্ধু, সমুদ্র, সরোবর, সীন, ইড়া, সুষুম্না ত্রিবেণী, সর্প, কুলকুণ্ডলী প্রভৃতি বহুবিধ রূপক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে গুরু তার শিষ্যকে দেহের এ সাধনা সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করতেন। অবশ্য নিষ্কাম সাধকরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করতেন মনিপুর, মূলাধার, ছয় চোরা, রংমহল, কামের তুফান, প্রভৃতি শব্দ।
১.
ও মন থাকোরে সাবধানে রংমহল লুটি নেয় রিপু ছয় জনে। ভক্তির কপাট দিয়ে তার মূল রাখো গোপনে ঘর চোরেতে যুক্তি করে বেড়ায় ধনের সন্ধানে। সাবধানে রাখিবে ধন কেও যেন না জানে শত্রু বিনে মিত্র নাই জানিবে আপনে। ভিতরেতে ছয়জন শত্রু বাইরে শত্রু অগনা তিরিপুত্র কেউতো নয়রে তোমার আপনা । ভাইরে রাধারমণ বলে তুমি আছ কি মনে মূল নাশিয়া বিনাশিব শত্রু ছয়জনে ।
২.
ও মন কেমন আছরে ভাইরে নতুন বেপারী রে ভাঙ্গা নায়ের মাঝি। আম খাইলাম রসে রসে কাঁঠাল খাইলাম কুসে মনিপুরে ধন হারাইলাম কামিনীর কূলে রে ॥ হায়রে পাগল মনা আগে আছলে কই কে তোরে পাঠাইল ভবে সে বা রইল কই। আদিল শাহ থাকিবে হইয়া কাতর ত্রিপাকে বাঁধিয়া রাখতে গৃহস্থের ছাগল ॥
পরবর্তীতে অবশ্য এদুটি দল সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল। বাউল গানে চৌদ্দ ভুবন, সপ্তদ্বীপ নয় দরজা, আট কুটরি এবং অসংখ্য সাগরের ব্যবহার প্রত্যক্ষ গোচর। শরীরের বিভিন্ন রন্ধসমূহ দরজা ও কুঠরী এবং তরল পদার্থ সমূহ মূলত সাগর হিসেবে হয়েছে উপস্থাপিত।
যেমন- নাসিকা, কর্ণ, নাভি, মুখবিবর, লিঙ্গ, পায়ুপথ প্রভৃতি এবং মূত্র, শুক্র, মল, ক্লেষ্মা ঘাম প্রভৃতি। বাউল মতে, মূত্রে লঙ্কাসমুদ্র, শুক্রে ক্ষীরোদ সাগর এ শোণিতে সুধা সাগর। তবে তারা চর্মকে ঘৃত সাগর, মজ্জাকে দধি সাগর এবং কটি বন্ধকে ইক্ষু সাগর হিসেবে করেছেন উদ্ধৃত।
এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন- সিলেটের মরমী সাধনায় (বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশের বাইরের অন্যান্য অঞ্চলের মতো) স্রষ্টার সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ককে দেহজ প্রেমের সম্পর্কে প্রকাশের একটি ব্যাপক আয়োজন দেখা যায়। এ বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবীদার। যেহেতু মার্গীয় সাধনায় অনন্তের পথে যাত্রার প্রস্তুতিপর্বটি হচ্ছে সান্ত-কে অথবা সীমিত দেহজ জীবনকে অতিক্রম করা, এজন্য দেহকে এবং দেহের সকল প্রয়োজনকে অস্বীকার করার শক্তি ভক্তকে অর্জন করতে হয়। কিন্তু প্রেম সাধনায় এই অস্বীকৃতির রূপটি ভিন্ন। এখানে দেহজ প্রেমের নানা প্রকাশকে কামনা, বাসনা, বিরহ, জ্বালা ও যন্ত্রণা- আত্মস্থ করেই শুধু এ থেকে উত্তরণ সম্ভব, এমনটি ভাবা হয়ে থাকে।
যদি শারীরিক প্রেমের সবগুলো প্রকাশ একজন ভক্তের জানা হল না, তার পক্ষে এসব থেকে উচ্চতর মার্গে যে নিষ্কাম, অন্তহীন, আকার আকৃতিহীন প্রেম আছে, তা জানা সম্ভব হবে না। যদি সৃষ্টিকর্তার প্রেমকে কেউ অনুধাবণ করতে চায়, তাকে পার্থিব প্রেমের প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। কেননা, স্রষ্টার প্রেমকে সে তার সীমাবদ্ধ স্বরূপেই দেখতে পাবে।
আর যদি শারীরিক প্রেমের প্রকাশগুলো আত্মস্থ করে সে শরীরহীন প্রেমে, অর্থাৎ প্রকৃত বিমূর্ত প্রেমে অভিষিক্ত হতে পারে, স্রষ্টার প্রেমরূপ সে সহজেই শনাক্ত করতে পারবে, এবং তার প্রেমভক্তি পুরস্কৃত হবে। এই চিন্তাটি মরমী অনেক সাধকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আশিক-মাশুকের বিবরণে যখন স্রষ্টার প্রতি ভক্তের প্রচণ্ড প্রেমের প্রকাশ ঘটে, তখন তার অনুসন্ধানের একটি স্তর সে অতিক্রম করতে থাকে, যার সর্বশেষ প্রান্তে আছে নিষ্কাম, কায়াহীন অনন্তের প্রেম।’৬
কেউ কেউ অবশ্য বাউলদের এমন আচরণকে কুৎসিৎ আখ্যায়িত করে নিন্দা করেন।৭ দেহ সাধনার নামে অবাধ যৌনাচার-এর বিষয়টি অসামাজিক বলেই তাদের নিকট অগ্রহণযোগ্য। এতদ্ব্যতীত বাউলগণ যদি দেহের মল, মূত্র, বীর্য, রজঃকেত্ত পবিত্র জ্ঞানে ভক্ষণ করেন তবে তো কথাই নেই। বাউল না বলে এদের সরাসরি পাগল বলতেই তারা হবেন বাধ্য।
কিন্তু আমাদের ধারণা উপর্যুক্ত গবেষকগণ ব্যাপক গবেষণা না করেই অমন মন্তব্য করেছেন। কারণ বাউলগণ যে সত্যি সত্যি মল ভক্ষণ করতেন তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ বাউলসঙ্গীতে নেই। তবে রোগ নিবারণার্থে মূত্র পানের বিষয়টি ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে অনুমোদিত। এমনকি স্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইত্ত সুস্থ থাকার জন্য দীর্ঘদিন পান করেছেন নিজ মূত্র।
দেহ মিলনের বৈধতা অবৈধতার বিষয়টি সমাজ জীবনের আধুনিকতম শৃঙ্খলার একটি। মানুষের সমাজবদ্ধ হয়ে নির্দিষ্ট পরিবারে পরিচিত ও চিহ্নিত থাকার বাসনা থেকেই যৌন জীবনে আসে নিয়ম কানুন। প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে জন্মশাসন করা সম্ভব হতো না বলেই পাপ-পুণ্যের বিধান দিয়ে কঠোরভাবে একে করা হয় নিয়ন্ত্রণ।
সর্বপাপের বড় পাপ রূপে আবির্ভূত হয় তখন স্বামী-স্ত্রী বর্হিভূত যৌন মিলন। বাউলদের যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো পরিবার নেই; নেই কোনো বংশ পরিচয়, পারিবারিক উপাধি- পরিচিতি- নাম-, তাই তাদের এই বিধি নিষেধের কী প্রয়োজন? প্রয়োজন নেই বলেই বউলগণ একে উপেক্ষা করেছেন। সংসারীদের থেকে সবদিক দিয়েই তাঁরা হয়েছিলেন ব্যতিক্রম।
বাউল সাধনায় গুরু বা মুর্শিদ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। কারণ তার নির্দেশেই শিষ্যরা বিভিন্ন পথে সাধনায় অগ্রসর হন এবং গানের মর্মার্থ অনুধাবনের চেষ্টা করেন। তাই গুরু বা মুর্শিদকে কেন্দ্র করে তাঁরা বহু সঙ্গীত রচনা করেছেন-

১.
মুর্শিদ বলি নৌকা ছাড়ো তুফান দেখি ভয় করিও না
মুর্শিদ নামে ভাসলো তরী অকূলে ডুবিবেনা।
নদীর নাম কামিনী সাগর, লাফে লাফে উঠছে লহর
কত নদীর ভরা খাইছে মারা দড়িয়া নদীর বিষম ধানে।
মনিপুরে মাঝি চাইরজনা নাওয়ের মাঝি আর ছয়জনা
আসিফে কামের তুফান, সাবধান সাবধান হাইল ছাড়িওনা।
ভাইবে রাধারমণ বলে অজ্ঞান মন তুই রইলে ভুলে
সেই তরীর মুর্শিদ কান্তারি সে তরী কখনো ডুবে না ।
২.
সুজন মন মনরে যাইওনা তরী বাইয়া
হাতে রাইখ প্রেম ডুরি নায়ের বাদাম
দেও টাঙ্গাইয়া রে ॥
ছয়জন যুক্তি করে ছয় দিকে বসিয়া
লাভে মূলে সব হারাইলাম
কামিনীরে কূলে পাইয়া রে ।
আকাশটা কদমের নৌকা জল উঠে বাইন চুয়াইয়া
সাবধানে চালাও তরী
নদীর কিনারা ভিড়াইয়া রে ।
শ্রীগুরু কাণ্ডারী মন কুমতি ছাড়িয়া
গুরুর কৃপা হইলে নদী
যাবে পাড়ি দিয়ারে ।
দীননাথ কয় ভাঙা তরী কত রাখিবে সিচিয়া
দোকান তোলো বাড়ি চলো
সময় গেল গইয়া রে।
তবে পূর্বের বাউলদের সঙ্গে বর্তমান কালের বাউলদের পার্থক্য বিস্তর। পূর্বে জন্মসূত্রে কেউ বাউল হতেন না। বাউল হতে হতো দীক্ষা-গ্রহণের মাধ্যমে। বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরিধান পূর্বক গুরুর নিকট থেকে দীক্ষা গ্রহণ করে তাঁরা বাউল রূপে জীবন শুরু করতেন। বাউলরা দীক্ষা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নিজদের জ্যান্তমরা ভাবতেন। গুরুগৃহ বা আখড়ায় দেহ রেখে কেবল আত্মাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা চলছেন; এমন ভাব নিয়ে শুরু হতো তাঁদের নতুন পথ চলা।
বাউল হিসেবে যারা দীক্ষা গ্রহণ করতেন তাঁদের সকলেই যে পদকর্তা ছিলেন এমন নয়। আবার বাউলসঙ্গীত যারা রচনা করেছেন তাঁদের সকলেই যে দীক্ষা গ্রহণকারী বাউল; এমনও নয়। নিছক এই মত ও পথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও অনেকে বাউল গান রচনা করছেন।
বস্তুত বর্তমানে যারা বাউলসঙ্গীত রচনা করছেন। তাদের প্রায় সকলেই পূর্ববর্তী বাউলদের বংশধর। তবে পূর্ব পুরুষদের মতো এদের অনেকেই বাউল মতে দীক্ষিত নন। মূলত যে ধর্মসমূহের প্রতি বিদ্রোহ করে তাদের সৃষ্টি; সেই ধর্মসমূহের মধ্যে বিলীন হয়েই তারা বর্তমানে সঙ্গীত রচনা করে চলেছেন। তবে গানের ভাব ও বক্তব্যে পূর্ববর্তী বাউলদের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে বলেই আমরা এদের বাউল বলে করছি সম্বোধন।৬
বাউলদের দর্শন ও সাধনা
(যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে)
এ বিশ্ব জগতের সবচেয়ে পরিপূর্ণ জীব মানুষ এবং তার জন্যই বিশ্বের সবকিছু নির্মিত। মানুষের জন্যই পাহাড়-পর্বত, মানুষের জন্যই নদী-সাগর, মানুষের জন্যই আকাশ-বাতাস, মানুষের জন্যই ফুল-ফল, মানুষের জন্যই বৃক্ষ-লতা, মানুষের জন্যই ধুলি-মাটি, মানুষের জন্যই চন্দ্র-সূর্য, মানুষের জন্যই গ্রহ-নক্ষত্র, মানুষের জন্যই পশু-পাখি এবং মানুষের জন্যই শত-সহস্র; লাখো ৮ কোটি মানুষ।
যে মানুষের জন্য সৃষ্টিকর্তা এত কিছু কিংবা বলা যায় সবকিছু সৃষ্টি করেছেন সেই মানুষ নিশ্চয়ই তাঁর সবচেয়ে পছন্দের সৃষ্টি। নিশ্চয় তিনি মানুষের মধ্যেই নিজেকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন, নিশ্চয় মানুষের মধ্যেই তিনি নিজেকে স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করেন, নিশ্চয় মানুষের মধ্যেই তিনি নিজেকে করেন প্রকাশ।
কাজেই স্রষ্টাকে খুঁজতে অরণ্যে কেন? স্রষ্টাকে খুঁজতে মন্দিরে কেন? কেন স্রষ্টাকে খুঁজতে মসজিদ-তীর্থে দৌড়াদৌড়ি? মানুষকে ছেড়ে তিনি কোথায় থাকতে পারেন? নিজের প্রিয় বস্তু পরিত্যাগ করে তাঁর পক্ষে কি দূরে থাকা সম্ভব? তবে কেন আমরা দূর-দূরান্ত পাড়ি দিচ্ছি? মানুষ ছেড়ে কোথায় খুঁজছি তাঁকে? -কেন? বাউলরা এ ভুল করতে রাজি নয়।
তারা মানুষের চেয়ে বড় আর কাউকেই ভাবতে পারেন না। ঈশ্বর যদি অস্তিত্ববান হয়ে থাকেন তবে শূন্যে নয়, দালানে নয়- অরণ্যে নয়; মানুষের মধ্যেই তার অবস্থান। মানুষের মনে অন্তরে, বিবেকের কোথাও লুকিয়ে তিনি সবকিছু প্রত্যক্ষ করছেন। অথচ আমরা তাকে দেখছিনা। আমরা তাকে চিনতে পারছিনা। বাউল তাই মানুষ ভজে। মানুষের সঙ্গে তারা করে প্রেম।
বস্তুত বাউলগণ কেবল কবি বা গীতিকারই ছিলেন না; তারা ছিলেন সাধক- দার্শনিক। আর তাই ভারত আরবের প্রায় বিপরীতধর্মী মতের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে তারা সৃষ্টি করলেন নতুন আর একটি মত। পূর্ববর্তী মতের সর্বজনীন দিক তারা গ্রহণ করলেন ঠিক কিন্তু বর্জন করলেন অনুদার সঙ্কীর্ণ দিক সমূহ। সকল ধর্ম, সকল গ্রন্থ পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্টি করলেন নতুন তত্ত্ব; সৃষ্টি হলো নতুন গান আর প্রথমবারের মতো মানুষ পেলো এ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উচু স্থান।
বৈষ্ণব, সুফিদের মতো জীবাত্মার মধ্যে পরমাত্মার অস্তিত্ব উপলব্ধির মধ্যেই তাঁদের সাধনা; গবেষণা শেষ হয়ে গেলোনা। তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন সমগ্র শরীর, সমগ্র মন। কোথায় সেই মনের মানুষ? কোথায় সেই অচিন পাখি? কোথায় সেই পরম ধন?
মানুষের আবেগ, মানুষের চিন্তা, মানুষের মন, মানুষের শক্তি, মানুষের সাহস, মানুষের ধৈর্য, মানুষের আকাঙ্ক্ষা, মানুষের ইচ্ছা, মানুষের লোভ, মানুষের লালসা, মানুষের কাম, মানুষের কামনা, মানুষের অঙ্গ, মানুষের যৌনাঙ্গ, মানুষের গর্ভ, মানুষের ইন্দ্রিয়- মোট কথা মানুষের কোনো কিছুকেই তারা বাদ দিলেন না। শক্তি অনুযায়ী গভীরভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে তারা ভিন্ন একটি পন্থায় অদৃশ্য শক্তিকে অনুভব, উপলব্ধি ও প্রকাশ করার চেষ্টা করলেন।
যেখানে মানুষ নেই- সেখানে বাউল নেই। আবার যা নেই মনুষ্যে- তা নেই বিশ্বে। অতএব, যা আছে ভাণ্ডে তা-ই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। মানুষের দেহেই সব বর্তমান। যা দিয়ে জগৎ সৃষ্টি; তা দিয়েই শরীর সৃষ্টি। অতএব শরীরে আর ব্রহ্মাণ্ডে কোনো তফাৎ নেই। যা শরীর- তাই দেহ। যা ভাও- তাই ব্রহ্মাণ্ড। যত্র জীব- তত্র শিব।
নিম্নে কয়েকটি বাউলসঙ্গীত উদ্ধৃত হলো:
১.
খাঁচার ভিতর অচিন পাখী কেমনে আসে যায়
(তারে) ধরতে পারলে মন বেড়ী দিতাম পাখীর পায় ।
আট কুঠুরী নয় দরজা আটা
মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাটা
তার উপরে সদর কোঠা
আয়না মহল তারা।
কপালে মোর নইলে কি আর
পাখিটির এমন ব্যবহার।
খাঁচা খুলে পাখি আমার
কোন বনে পালায়।
মন, তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর তৈরি কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে
লালন কেঁদে কয়।
লালন কয় খাঁচা খুড়ে
সে পাখী কোনখানে পালায়।
২.
আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে
দেখ নারে মন চেয়ে।
দেশ-দেশান্তর দৌড়ে এবার
মরিস কেন হাঁপিয়ে।
করে অতি আজব ভাক্কা
গড়েছে সাঁই মানুষ-মক্কা
কুদরতে নূর দিয়ে।
ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম
মধ্যে সাঁই বসিয়ে ॥
মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ
উঠছেরে আজগুবি আওয়াজ
সাততলা ভেদিয়ে।
আছে সিংহ-দরজায় দ্বারী একজন
নিদ্রাত্যাগী হয়ে।
দশ-দুয়ারী মানুষ-মক্কা
গুরু পদে ডুবে দেখ পা
ধাক্কা সামলায়ে।
ফকির লালন বলে, সে যে গুপ্ত মক্কা
আদি ইমাম সেই মিঞে
ওরে সেথা যাই
কোন পথ দিয়ে ।
৩.
সাধের মানুষ জনম আর হবে না
দিন গেলে কী পাবে
দিন গেলে কী পাবে রে মন
সময় গেলে কী হবে।
বেদ পুরাণে গেল জানা
মানুষ বিনে কেউ পাবেনা
কর মন মানুষের সঙ্গে
মানুষ নামটি রবে ।
হিন্দু কিংবা মুসলমান
জীব আত্মা এক সমান
আচার বিচার নাইরে মন
তোর জাত কুলে কী দিবে ।
ফকির আছিম শা’র বাণী
জন্ম নিলাম মুসলমানী
জঙ্গল কাটা হয় না বারণ
সে মান কি আর রবে।

সংক্ষেপে বাউল:
১. বাউল একটি মতবাদ ও একটি সঙ্গীতের নাম।
২. প্রধানত সুফি ও চৈতন্যমতবাদের মিশ্রণে এই মতের সৃষ্টি; তবে নাথ এবং বৌদ্ধমতের প্রভাবও এতে খানিকটা প্রত্যক্ষ হয়।
৩. বাউলগণ স্রষ্টাকে পরমাত্মা ও নিজেদের জীবাত্মা মনে করে দেহ তথা মানুষের ভজনা করেন। তাদের ধারণা জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি।
৪. বাউলদের সঙ্গীতে সুফিদের সামা ও বৈষ্ণবদের পদাবলীর সুরের প্রভাব বেশি। তবে অন্যান্য সুরও এতে হয়েছে মিশ্রিত।
৫. বাউলদের কোনো নির্দিষ্ট উপাসনালয় নেই; নেই বিধিবদ্ধ তেমন কোনো আচার-আচরণ। তাঁরা সৃষ্টিকর্তাকে আল্লাহ, খোদা, ঈশ্বর, কৃষ্ণ, সাঁই সব নামেই সম্বোধন করেন।
৬. সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাঁরা গুরুর নিকট হন শরণাপন্ন হন।
আরও পড়ূনঃ
