বাউল, বৈষ্ণব ও সুফি সঙ্গীত – বাউল শিল্পী বা বাউল সাধক বা বাউল একটি বিশেষ ধরনের গোষ্ঠী ও লোকাচার সঙ্গীত পরিবেশক, যারা গানের সাথে সাথে সুফিবাদ, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি মতাদর্শ প্রচার করে থাকে। বাউল সাধক বাউল সঙ্গীত পরিবেশন করে থাকে। মূলত বাউল সংগীত একধরনের বাংলা সুফিবাদ সংগীত ছিল। বাউল গান পঞ্চবিংশ শতাব্দীতে লক্ষ্য করা গেলেও মূলত কুষ্টিয়ার লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল মত পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের নিকট। বাউলদের সাদামাটা জীবন ধারণ ও একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউলদের বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।

Table of Contents
বাউল, বৈষ্ণব ও সুফি সঙ্গীত
এক. দীন শরতের বাউল গান
প্রশ্ন:
একটি পরম তত্ত্ব জানব বলে বাসনা আমার। পতিত পাবন দয়াল গুরু তুমি সর্ব মূলাধার ।
কেবা গুরু কেবা শিষ্য কে গড়িল এই যে বিশ্ব।
আমি অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য
আমায় ঘুচাইয়া দাও অন্ধকার।
আমার হইল কিসে দেহের গঠন দেহে আছে কোন মহাজন।
গুরু শিষ্য আমরা দুজন আগে জন্ম হইল কার ।
দীন শরৎ বলে তুমি সত্য ভূত ভবিষ্যৎ তুমি নিত্য।
আমায় বলে দিয়ে পঞ্চতত্ত্ব ভবসিন্ধু কর পার
জবাবঃ
দেহের গুরু পরমাত্মা শিষ্য হয়রে মন।
গুরু শিষ্য এক হইলে আসা যাওয়া হয় বারণ ।
প্রকৃতি পুরুষ হইতে, মহত্তত্ত্বের জন্ম তাতে।
আকাশাদি পঞ্চভূতে হইয়াছে দেহের গঠন ।
বীজ হইতে জন্মে বৃক্ষ, বৃক্ষেতে হয় ফল প্রত্যক্ষ।
ঐ যে দেহ দেহী এই সম্পর্ক, কর তত্ত্ব নিরূপণ ।
পাঁচ পাঁচ পঁচিশের তত্ত্ব, জেনে শুনে হওরে মত্ত।
আছে পঞ্চ আত্মা দেহস্থিত দশে ছয়ে ষোলজন।
দীন শরৎ বলে তত্ত্ব জেনে সাধ্য বস্তু লওরে চিনে ।
বাধ্য করে ষোল জনে
করবে তার অন্বেষণ ॥
২. প্রশ্ন:
আকাশ বায়ু বহ্নি ধরা না ছিল যখন। না ছিল সেই চন্দ্র সূর্য্য ব্রহ্মা বিষ্ণু পঞ্চানন ।
নিরাকার সব নিরাকৃতি না ছিল কোন আকৃতি সে কালে পুরুষ প্রকৃতি
কেমনে হইল সৃজন। ব্রহ্মা শব্দের কিবা অর্থ কোন আকৃতি কি পদার্থ।
সগুণ কিবা গুণাতীত সচেতন কি অচেতন।
দীন শরৎ বলে ভাবছি বসে এ ব্রহ্মাণ্ড হল কিসে।
গুরু বলে মোরে কোন পুরুষে করিলেন সৃষ্টি পত্তন।
জবাব:
পরমাত্মা পরম ব্রহ্ম নির্গুণ সে নিরাকার। ব্রহ্মাণ্ড সৃজন তরে, আপনি হইলেন সাকার ॥
অনাদির আদি যিনি
প্রকৃতি সৃজিলেন তিনি।
শূন্য ভরে পুরীখানি
করিলেন বর্তুলাকার ।
শক্তি গর্ভে অন্ত হইল অন্তেতে ব্রহ্মাণ্ড রইল।
তা’তে মহাবিষ্ণু জনমিল ক্ষীরোদে বসতি যার ।
শক্তি হইলেন ললাটেতে চন্দ্র সূয্য নয়নেতে।
আকাশ হল মন হইতে
নিঃশ্বাস পবন তার ।
প্রকৃতি পুরুষ হইতে মহত্তত্ত্বের জন্ম তাতে
দীন শরৎ বলে ত্রিগুণেতে জন্ম হইল তিনজনার ।
৩. প্রশ্ন:
সত্ত্ব রজঃ তমঃ গুণে, ব্রহ্মা বিষ্ণু হর।
আপন আপন বিষয় নিয়ে মত্ত আছেন নিরন্তর ।
সৃষ্টি করেন পদ্মযোণি পালন করেন চক্রপানি।
শূল হাতে শূলপাণি সংহার করেন চরাচর ।
কেবা জীবের মুক্তিদাতা বল গুরু তত্ত্ব কথা।
কে হইয়াছেন মূল দেবতা কারে ভজে সুর নর।
বিষয়ী যে জন হইয়াছে হুকুম মত কাজ করতেছে।
তিনের উপর কেবা আছে নিখিল ব্রহ্মাণ্ডেরেশ্বর ।
দীন শরৎ বলে সেই মূলাধার সাকার কিবা হয় নিরাকার।
গুরু বলে মোরে তাই সারাৎসার তত্ত্ব কথার সদুত্তর ॥
জবাব:
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিবে করে সৃজন পালন লয়।
তিন হতে হয় এ ব্রহ্মাণ্ড একে তিনে ভিন্ন নয় ।
ব্রহ্ম উপাসক কত কেহ বা হয় ভাগবত।
শৈব শাক্ত গাণপত্য ভিন্ন ভিন্ন মত রয় ।
যে যাকে ভজনা করে
সেই তো মুক্তি দিতে পারে।
ছোট বড় বলব কারে
এক ভিন্ন দ্বিতীয় নয় ।
নিরাকার যে জন হইয়াছে
তার কিরে মন ভজন আছে। আকার মূর্তি ধরিয়াছে পূর্ণ ব্রহ্ম জ্যোতির্ময় ॥
দীন শরৎ বলে তত্ত্ব জেনে সাধ্য বস্তু লওরে চিনে যারে সদায় ভাবে তিনে, প্রতি ঘটে সে জন রয়।
8. প্রশ্ন:
শৈব শাক্ত গাণ-পত্য মতের অন্ত নাই।
শিব শক্তির ভজন কথা তব মুখে শুনতে পাই ।
কেবা মুখে কেবা শক্তি শিব শক্তির কি আকৃতি।
কোন দলে হয় কার বসতি কেমনে তাহারে পাই ।
গুরু তব মুখে শুনি প্রতি ঘটে আছেন তিনি। এই
আমার দেহখানি শিব শক্তি ছাড়া নাই। বেদে বলে শিবই সত্য জানলাম না সেই পরমতত্ত্ব।
শিব শক্তির কি মাহাত্ম্য কও শুনি হে দয়াল গোঁসাই ।
দীন শরতের এই বাসনা লয়ের কর্তা হয় যে জনা।
তবে জন্ম আর যে হয় না তার পদে লয় হয়ে যাই
জবাব:
শিব শক্তির সাধন তত্ত্ব জানলে নারে মন।
তরবে যদি ভবনদী শক্তিকে কর সাধন ।
ভূজঙ্গিনী রূপ ধরে আছেন শক্তি শূলাধারে।
সাড়ে তিন প্যাচেতে ঘিরে মহানিদ্রায় অচেতন ।
মহামায়া আদ্যাশক্তি শক্তি হইতেই জগৎ মুক্তি।
গুরুর কাছে নিয়ে যুক্তি শক্তিকে কর চেতন।
শিঙ্গা ডমরু নিয়ে করে আছেন শিব সহস্রারে।
শিব শক্তির মিলন করে পুরাও মনের আকিঞ্চন।
ভেবে দীন শরৎ বলে
শিবই সত্য ভূমণ্ডলে।
বিনাশ নাই যার প্রলয় কালে সেই ত বিশ্বের মূল কারণ ।
৫. প্রশ্ন:
আমায় কও শুনি হে গুরু ধন
দেহের খবর জানতে আমার মনের আকিঞ্চন।
দেহে আছে ষট্ চক্র,
কোন চক্রে কোন মহাজন ।
ঐ যে গুরু পঞ্চ আত্মা হয়
কও শুনি হে কোন চক্রেতে কোন আত্মাধন রয়।
আত্মা শব্দের অর্থ কি হয় জানতে চাই তার মূল কারণ ।
ছয়টি পদ্মে ছয়টি শক্তির বাস কোনটি শক্তির কি নাম হয় জানতে অভিলাষ।
কোন পদ্মে কে বিরাজ করে কোন আকার করে ধারণ।
দীন শরৎ বলে দয়াল গুরুজী তুমি না জানালে তত্ত্ব জানবার উপায় কি?
পরমকে না জানলে নাকি মানব জন্ম অকারণ ।
জবাব:
আগে মূলের তত্ত্ব জানতে হয়, চতুর্দশে মায়ের কোলে, জীব আত্মাধন রয়। মায়া ডাকিনী শক্তি সে পদ্মে জীবের আশ্রয় ।
ষড়দলে রাকিনী শক্তি ভূতাত্মার বসতি হয় পুরানের উক্তি। আছেন লাকিনী সেই দশম দলে আত্মারাম সেখানে রয় ।
দ্বাদশ দলে আত্মা রামেশ্বর,
কাকিনী নামেতে শক্তি পদ্মের উপর।
চতুর্ভুজে আছেরে তার বাস করাল আর বরাভয় । ষোড়শ দলটি কন্ঠেতে জানি দশভূজা শিব তথা শক্তি সাকিনী।
ভ্রু মধ্যে দ্বিদলে মন, হাকিনী সেখানে রয় । দীন শরৎ বলে সহস্র দলে পরমাত্মা বিরাজ করেন মহাজন বলে। আছেন মহা কুণ্ডলিনী শক্তি পরম শিব জ্যোর্তিময় ।

দুই. রাধারমণের বৈষ্ণব সঙ্গীত
১.
শুন এগো প্রাণ ললিতা
কি বলব বাঁশির কথা
শুনিয়া বাঁশির ধ্বনি মন হৈয়াছে পাগলিনী তারে না হেরিলে প্রাণ যায় ।
ধ্বনি শুইনে গৃহে থাকা দায় যত নারী আছে ব্রজে সবাই থাকে গৃহকাজে আমি গৃহে রহিতে না পারি।
ঘরে গুরুজনের জ্বালা তার উপরে বাঁশির জ্বালা এত জ্বালা সহিব কেমনে।
ধরি সখি তোদের পায় কোথা শ্যাম বাঁশি বাজায় রাধারমণ ভেবে বলে চল সেথা যাই চলে যেথায় শ্যামে বাঁশিটি বাজায় ।
২.
শ্যামের বাঁশি বাজিল বিপিনে বাঁশির ধ্বনি উন্মাদিনী প্রাণে কি আর ধৈর্য মানে । যে নাগরে বাজায় বাঁশি মন লয় তার হইতেম দাসী। গোকুল মজাইল শ্যামের বাঁশির গানে বাঁশির তানে শূন্য তনু-প্রাণ থাকে কেমনে । বাঁশির মধু কতই মধু ঘরের বাহির কৈরে নেয় কুলবধূ শ্যামের বাঁশি কি মোহিনী জানে কেয়া ফুলের কাঁটার মতো বিন্দিল পরাণে। কেমন গো সই বংশীধারী কেমন কার রূপ মাধুরী সাধ করে মেলিতে নয়নে কি অমৃত বাজায় বাঁশি কহে রাধারমণে ।
৩.
শ্যামের বাঁশি মন উদাসী কি মধুর বাজিল কানে প্রাণসই কাজল বাঁশি গহিন কাননে ।
নতুন বাঁশের বাঁশি নতুন বয়সের কালশশী নতুন নতুন বাজাও বাঁশি বিষম সন্ধানে ॥
আমার মন হইয়াছে উন্মাদিনী প্রাণে কি আর ধৈর্য মানে ॥
পুলিনে যমুনা ঘাটে কদম্ব কি বংশীবটে প্রাণে কি আর ধৈর্য মানে শ্রবণে শ্রীরাধারমণের কথা পূর্ণ হবে কত দিনে ।
8.
আসবে শ্যাম কালিয়া কুঞ্জ সাজাও গিয়া এগো কেনেগো রাই কানতে আছ পাগলিনী হইয়া । জাতিযুথী ফুল মালতী * আনগো তুলিয়া এগো মনোসাধে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া আতর গোলাপ চুয়াচন্দন কটরায় ভরিয়া এগো আমার বন্ধু আইলে দিও ছিটাইয়া ছিটাইয়া । লং এলাচি জায়ফল জাতি বাটাতে সাজাইয়া আমার বন্ধু আইলে দিও খিলি মুখেতে তুলিয়া ॥ ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া এগো আসবে তোমার প্রাণ বন্ধু বাঁশিটি বাজাইয়া ॥
৫.
কেন কুঞ্জে না আসিলে কঠিন শ্যামরায় ।
সখি গো তোরা সব সখিগণ যালো বনে বনে বৃন্দাবনে যালো বৃন্দে বন্ধু-অন্বেষণায় ॥
চেয়ে দেখ প্রাণ সইগো শশী অস্ত যায় বন্ধু বিনে প্রাণ আমার রাখা দায় ।
সখিগো শুন শুন প্রাণ সই গো মোর নিবেদন দারুণ বিরহে প্রাণ করে উচাটন ।
শ্যামনাম লয়ে প্রাণ উঠে যেতে চায় মনোচোরা মদনমোহন রয়েছে যথায়
সখি গো চেয়ে দেখো প্রাণ সই গো নিশি গাইয়া যায়,
আর কি আসিবে কুঞ্জে নিঠুর শ্যামরায় অতি-সাধর বকুলমালা বাসি হইয়া যায়
আসিল না প্রাণেশ্বর করি কি উপায়
দেখগো কান্দিয়া কান্দিয়া রাই কুঞ্জের বাহির হয়।
কুঞ্জ বনের তরুলতায় জিজ্ঞাসা করায় ।
রাধারমণ বলে রাই কিবা পাগলিনী হয় সখিরা ধরিয়া রেখে রাধাকে বুঝায় ।
তিন. সাইদ বয়াতির সুফিসঙ্গীত
১.
রহিমুন করিমুন ছামিয়ুন বাছিরুন খালেকুন খোদা জলিলও জব্বারও মুতাকাব্বির খালেকুন হামিদুন হুয়াল
আছম ।
নিরাকারে সাঁই নিরঞ্জন ছিলা কুদরতে আবার প্রকাশিলা
পাঞ্জাতন নিয়া
ডিম্ব রূপে ভাইসা ছিলা কুন শব্দে হইল তালা ।
ফিতারা রূপে সাঁই ভাস আকাশে ময়ূর রূপে ভাস আবার
একিন গাছেরে।
সেইদিন নূর মোহাম্মদ সঙ্গে রাখিলে আখেরি নবী যিনি মুজাদ্দাদা
মাটি দিয়া পুতুল গড়ে লুকাইয়া আবার তার ভেতরে
করতে প্রেমের খেলা
কখন নবী কখন আল্লা, নিজ ছুরতে পড়লে আদমজাদা ।
সেই আদমকে সেজদা না করিয়া আবেদ গেল
মকরূম হইয়া কত নান্নত পাইয়া
তাই ভাবছে পাগল সাইদ মিয়া তুমি মাকারো
মাকরিম আরও মাকারোল্লা ।
সাইদ বয়াতির ব্যাখ্যা: কোরানে আল্লাহর একশত নাম রয়েছে। প্রতিটি নামে ভিন্ন গুণ প্রকাশিত। সমস্ত গুণ একত্র করে গানের ভাষায় রহিমুন (দয়ালু), করিমুন (সবকিছু সম্পাদন করার ক্ষমতা), ছামিয়ূন (শ্রাবণ করার শক্তি), বাছিরুন (সর্বদ্রষ্টা), খালেকুন (পৃথিবীর সৃষ্টি কর্তা), সংক্ষেপে গানে ব্যবহার করা হয়েছে।
পৃথিবী সৃষ্টির আগে স্রষ্টা বা পরমসত্তা নিরাকারে ছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল নিরঞ্জন। নিরঞ্জন শব্দের অর্থ চোখের পানি। পরমসত্তা যখন ডিম্বরূপে পানির মধ্যে ভাসতে থাকে সেই ডিম্বের মধ্যে পাক পাঞ্জাতন থাকেন। পাক পাঞ্জাতন হলেন-১। ফাতেমা, ২। নবী, হযরত মোহাম্মদ (দঃ) ৩। হযরত আলী, ৪। ইমাম হাসান, ৫। ইমাম হোসেন। পরম সত্তার কুদরতি বা রুদ্র শক্তিতে ডিম ফেটে দুভাগ হয়ে যায়। ডিম থেকে পাঁচজন বেরিয়ে আসেন। আল্লাহপাক ছয়টি তারারূপে আকাশের গায়ে রাখেন পাক পাঞ্জাতনকে। সাজরাতুন একিন নামক বৃক্ষে এই পাক পাঞ্জাতনকে বসিয়ে রাখেন নয় লক্ষ বছর।

২.
নবী না চিনিলে ভবে সাধন ভজন অকারণ কোন সাধনে পাবে তারে নবী রত্ন ধন ।
ডিম্বরূপে বারোতালা নবী নিয়ে করে খেলা
মিলাইতে নূরের মেলা আকাশে রয় পাঞ্জাতন
ময়ূররূপে একিন গাছে ময়ূর নয় ময়ূরী নাচে
শরমের এক আর না কাছে খেলা মেলে নিরঞ্জন ॥
সেই নবী চিনলে চিনবে খোদা আল্লা নবী নয়গো জোদা
আল্লার নূরে নবী পয়দা তার নূরে হয় বিভুবন
নূরে নিরে আছে ঘেরা তরিকার পড়েছে ধরা
যে হইলো সেই তত্ত্বে মরা সেই পাবে তার দরশন ।
হায়াতুন মোরাছানিল নবী বুজুর্গে আছে নবীর ছবি
নামে প্রেমে মত্ত হইয়া ভজরে গুরুর শ্রীচরণ
লাম, আলিফে দিয়ে কাওরা মরার আগে শেখ মরা
সাইদ বলে আবুল বাশার তয় করে লও তন আর মন ।
ব্যাখ্যা: সুফি সাধকদের মতে ডিম হচ্ছে মায়ের ডিম্বকোষ, যেখানে সন্তান জন্ম হয়। অন্য অর্থে ডিম বীজ বা বীর্য। বীজ বা বীর্যের মধ্যে নূর বা আলো লুক্কায়িত থাকে, যেমন দিয়াশলাইর কঠির মধ্যে আগুন লুকিয়ে থাকে। তেমনি পুরুষের বীর্যের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ মানুষ লুকিয়ে থাকে। সাজারতুল একিন আধ্যত্মিক মতে সঠিক। এটি বিশ্বাস বৃক্ষ।
একিন বা বিশ্বাস পাঁচ প্রকার। ১। বেলগায়ে একিন (না দেখে বিশ্বাস করা) ২। আয়নুল একিন (চোখে দেখে বিশ্বাস করা)। ৩। হুয়াল একিন (জেনে শুনে বিশ্বাস করা) ৪। এলমূল একিন (বইপুস্তক পড় বা জ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্বাস করা) ৫। হককুল একিন (অকাট্য বিশ্বাস)। জীব যখন সচেতন হয় অর্থাৎ মানুষ সাধনার মাধ্যমে যখন নিজেকে চিনে ফেলে তখন পরমসত্তা ও নিজ সত্তার মধ্যে একাকার হয়ে যায়। তখন যে নিজের মধ্যে পাক পাঞ্জাতন, সাজারতুল একিন, সিতারা-ময়ূর দেখতে পায় এবং উপলব্ধি করতে পারে। পাঁচটি গুণের সমন্বয়ে আদমের সৃষ্টি। দর্শন শক্তি, স্পর্শশক্তি, শ্রবণশক্তি, বাক্যশক্তি ও অনুভব শক্তি।
আলী হচ্ছেন সমস্ত শক্তির প্রতীক। হোসেন হচ্ছেন অনুভব শক্তির প্রতীক। মোহাম্মদ হচ্ছেন মানব ছবির চেহারার প্রতীক। সুফিদের মতে মানবদেহ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। ‘যাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে তাহা আছে দেহ ভাণ্ডে।’ তাই দেহে জোজ আলম বলা হয়। পৃথিবীকে বলা হয় কুল আলম।
অর্থাৎ মানবদেহে হচ্ছে একটি বৃহৎ জগৎ বা আলম। এবং পৃথিবী হচ্ছে একটি বৃহৎ জগৎ বা আলম। কিন্তু মানবদেহ আকৃতিতে ক্ষুদ্র হলেও পৃথিবীর সৃষ্টির রহস্যের চেয়েও মানবদেহের সৃষ্টি রহস্য আরো জটিল ও গভীর। মানবদেহে পরমসত্তা নব নব উদ্ভাবন ও সৃষ্টিশীল শক্তির মাধ্যমে নিরন্তর সৃষ্টি করে চলেছেন। নারী পুরুষ সাধন বলে কাম প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মৃত্যুর আগে মরে গিয়ে পরম সত্তার সঙ্গে মিলিত হতে পারে।

৩.
খোদার সৃষ্টির ভেদ বুঝনও ভিষম দায় এই বিশ্ব দুনিয়ায় ।
নিজের প্রেমে নিজেই মজে প্রেম খেলা খেলায় ।
(ও মনরে) সাঁই আমার গঞ্জ মুখফি নাম ধরিয়া গঞ্জ জাতে ছিল
অচেতনাতে ঘুরে বেড়ায় দলিলে আসিল
সেদিন পাক পাঞ্জাতন সঙ্গে নিয়া ছিল দয়াময় ।
(ও মনরে) নিজেই জানত না নিজে সেইদিন রব্বানি
নিজের মনেই বাঞ্জা হইল প্রকাশের কারনি
আচানক ধ্বনি করিয়া শব্দ হইল খাড়া
সেই শব্দে তামাম দুনিয়া হইল সৃষ্টির গোড়া
ফায়া কুন শব্দ করিল আপনি আপনায় ।
(ও মনরে) তখন ডিম্বরূপে ছি মৌলা ভাইসা নীরের পর
একা কভু প্রেম হবে না তাই করবে দোসর
আপন অঙ্গ হইতে এক ফোঁটা নূল তখন দিল ছেড়ে
নূরে নীরে মিলন হইয়া আহাদ নামটি ধরে
আহাদে আহাম্মদ নামে দোসরও সাজায় ।
(ও মনরে) মোহাম্মদ নূর তখনে বিভাগ করে দিল
আপনি এস্কে আপনি মজে জগৎ বুজাইল
অরুজ ছিল নজুল হইয়া ছিফাৎ করতে চায়
আপনার নূরতে আপনি সারেজাহান বানায়।
(ও মনরে) আল্লার নূরে হয় মোহাম্মদ দোস্ত বলে যারে
মোহাম্মদী নূরে মৌলা এ জগৎ দেয় গড়ে
আলা কুল্লে সায়িন মোহিদ কোরানে বসিল
সৃষ্টির মাঝে লুকাইয়া সাঁই গোপন হয়ে গেল
সাইদুর কয় আসেক বিনে এ ভেদ বুঝা দায়।
ব্যাখ্যা: আকারে সে প্রকাশের পূর্বে পরমসত্তা একাকী গোপনে ছিল। গঞ্জ মুখাফি হচ্ছে গোপন বস্তু বা পরমসত্তা। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য পরম সত্তা কুন ফায়াকুন শব্দ করে সৃষ্টির সূত্রপাত করেন। নিজের অঙ্গ থেকে মোহাম্মদী নূর সৃষ্টি করে সেই নূর থেকে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়। গাণের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য হলো এই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে কামশক্তি জাগ্রত না হয় ততক্ষণ সে নিজেকে অনুভব করতে পারেনা।
কামশক্তির প্রভাবে যখন চেতন হয় তখন তার মধ্যে প্রেম ও ভালবাসার সৃষ্টি হয়। একা একা প্রেম হয় না। আর একজনের প্রয়োজন হয়। প্রেম খেলা খেলানোর জন্য নূর বা আলোর ঝলকানি হয়। এটিই হলো নূরে মোহম্মদী। যখন প্রেম উন্মাদনায় পুরুষ একজন নারীকে খোঁজে তখন দুইজনের আলিঙ্গনে নূর টলে বা ঝলকায়।
পুরুষ পরমসত্তার সঙ্গে একাকার হয়ে নারীর সত্তায় মিশে যায় এবং তা থেকে সৃষ্টি-জগতের বিস্তার হয়। এটি সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এইভাবে সৃষ্টি চলমান। পুরুষ আহাদ বা পরম, নারী মোহাম্মদী শক্তির প্রতীক। নারী-পুরুষের মিলনের মাধ্যমে প্রেম ও ভালবাসার সৃষ্টি হয়। এই প্রেম ও ভালবাসা থেকে মোহম্মদী রূপের সৃষ্টি।

8.
অচেতনে চেতন পেয়ে প্রকাশ হইল দয়াময় পুসিদাতে অরুজ ছিল নজুল হইল সেই দয়াময় ।
আপনি আপন হয়ে চেতন শুধু সৃষ্টির হলো উদয় ।
অচেনা কোন গঞ্জের সেই ধন
অনন্ত কাল ছিল গোপন
ধনেতে হয় ধনের জোর
অচেনাতে নিশি হয় ভোর আপনাকে করে জহোর ছিফাত বিভক্ত হয়।
তাই ভেবে বলে সাইদ পাগলা
বিশ্বময় অনন্ত লীলা বলতে গেলে বারে জ্বালা মৌলার খেলা বুঝা দায়।
ব্যাখ্যা: অরুজের অর্থ স্থিতিশীলতা। নজুল-এক অর্থ আসা বা আবির্ভূত হওয়া, ভেঙ্গে বা ছিটকে পড়া-বিচ্ছিন্ন হওয়া। কামশক্তিকে সংযত রাখা বা নিষ্কাম থাকা অবস্থায় অরুজ বলে। কামশক্তি জাগ্রত হওয়ার পর বীর্যপাত হওয়াকে নজুল অবস্থা বলা যায়। উদাহরণ স্বরূপ সন্তান জন্ম হওয়া পর্যন্ত পিতা জাতে গণ্য থাকে।
সন্তান হওয়ার পর ঐ সন্তান ছেফাতে পরিণত হয়। তথ্যপঞ্জি: দীন শরতের বাউল গান- ডাঃ রবীন্দ্রনাথ দাসের কীর্তি মঞ্জুষা গ্রন্থ; রাধারমণের বৈষ্ণব সঙ্গীত- নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত (বাংলা একাডেমী) রাধারমণ গীতিমালা গ্রন্থ এবং সাইদ বয়াতির সুফি সঙ্গীত- শফিকুর রহমান চৌধুরী রচিত সাইদ বয়াতির সৃষ্টিতত্ত্ব; ভোরের কাগজ সাময়িকী; (২৬ ডিসেম্বর ২০০৩ খ্রিঃ) থেকে সংগৃহীত।

সুফি প্রভাবিত মুর্শিদি ও মাইজভান্ডারি গান
১.
মুর্শিদি
আর কিছু ধন চাইনা মুর্শিদ আর কোনো ধন চাইনা মুর্শিদ যাইতে তোমার সঙ্গে নিও ।
মুর্শিদি ও-
আমার মরণ কালে কলমা কালাম না পড়িও গো। আমার মুর্শিদ চান্দের মুখের বাণী আমার কানে শুনাই দিও ।
মুর্শিদি ও-
আমার মরণ কালে আতর গোলাপ না ছিটাইও গো। আমার সাত্তারের পায়ের ধূলো আমার গায়ে মাখাই দিও ।
মুর্শিদি ও-
আমার মরণ কালে ঝাড়ের বাঁশ বা কাটিও গো। আমার মুর্শিদেরই হাতের লাঠি আমার কবরে বিছাই দিও পরদেশীরে সঙ্গে নিও ।
-মুজীব পরদেশী (অডিও ক্যাসেট থেকে)
২.
মাইজভাণ্ডারি
দূর ফটিকছড়ি হইতে
আইলাম তোমার দরবারে
কোন সাধনে কাশেম বাবা
পাবো আমি তোমারে ।
মরা কাঁঠাল গাছে বাবা
কাঁঠাল তুমি ধরাইলা
আশেক গণে দেখে অবাক
কী অঘটন ঘটাইলা।
গোপনেতে খেলা চলে
আমার বাবার দরবারে ।
যে চিনেছে সেই বুঝেছে
কাশেম বাবা কেমন ধন
কানাঘুষা করে শুধু
না বুঝিয়া মূর্খজন
সময় থাকতে নাওরে চিনে
আমার কাশেম বাবারে ।
-শিল্পী শিমুল শীল (অডিও ক্যাসেট)
আরও পড়ূনঃ
