বৈষ্ণব সাধকগণ – সাধারণ অর্থে বিষ্ণুর উপাসক বৈষ্ণব এবং বৈষ্ণবদের সঙ্গীত বৈষ্ণব পদাবলী। কিন্তু বাংলাভাষার প্রথম বৈষ্ণব পদকর্তা বড়ু চণ্ডীদাস এবং বিদ্যাপতি উভয়ই অবৈষ্ণব। যে সময় হিন্দুধর্ম মূলত বৈষ্ণব, শাক্ত, বৌদ্ধ, শৈব প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভক্ত ও পরিচিত এবং যেসময় এ মতাবলম্বীদের মধ্যে খানিকটা অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা বর্তমান; সেই সময় বাসুলীর উপাসক বড়ু চণ্ডীদাস এবং শিবের উপাসক বিদ্যাপতির বিষ্ণু বা কৃষ্ণ সম্পর্কিত পদ রচনার বিষয়কে একটা মহৎ বা উদার মনোভাবের পরিচয় বলেই সমালোচকগণ মনে করেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় বিষয়টি সম্ভবত তা নয়।
কারণ কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচিত হলেও সেখানে কৃষ্ণকে আমরা দেবতার বৈশিষ্ট্যে প্রত্যক্ষ করিনা। এতদ্ব্যতীত যে রাধাকে সেখানে উপস্থাপন করা হয়েছে; সেই রাধাও মহাভারত, গীতার মতো মূল বৈষ্ণব সাহিত্যে নয় উপস্থিত। কাজেই বিষ্ণুর প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধার কারণেই চণ্ডীদাস এ কাব্য রচনা করেছেন; এ কথা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই।
একই কথা বিদ্যাপতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মিথিলার বিখ্যাত শৈব কবি বিদ্যাপতি বাংলা ভাষায় কৃষ্ণ বিষয়ক যেসব সাহিত্য রচনা করেছেন সেগুলো যে কৃষ্ণকে বৃহৎ বা মহৎ হিসেবে উপস্থাপনের জন্যই করেছেন-এ কথা সন্দেহাতীত ভাবে বলার যুক্তি কোথায়? বরং প্রকৃত কৃষ্ণ ভক্ত চৈতন্যের আবির্ভাবের পরই আমরা আদিরস বিবর্জিত বিশুদ্ধ ধারার বৈষ্ণব সাহিত্য প্রত্যক্ষ করি।

Table of Contents
বৈষ্ণব সাধকগণ
অবশ্য পূর্ববর্তী লেখকদের প্রভাবের কারণে কৃষ্ণের শৌর্য-বীর্য-বীরত্বের পরিবর্তে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম ভক্তি বিষয়ক কাহিনী এ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। জীবাত্মা ও পরমাত্মা পরিচয়ের রূপকে; সৃষ্টি ও স্রষ্টার পারস্পারিক আকর্ষণ, আবেগ, মান, অভিমান, বিচ্ছেদ প্রভৃতি এতে অনুপম সৌন্দর্যে হয় চিত্রিত। প্রাচীন শাস্ত্রে কৃষ্ণকে উদ্ধৃত করা হয়েছে বিষ্ণুর অবতার রূপে। আর এই অবতার তাঁর মর্তে ভূমিষ্ট হওয়ার কারণ জানাতে গিয়ে গীতায় বলছেন-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত,
অভ্যত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম ॥
পরিত্রানায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ॥
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ॥
[৪র্থ অধ্যায়]
অর্থাৎ যখন ধর্মের গ্লানি ও অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে, তখন তিনি নর দেহ ধারণ করেন। সাধুদের রক্ষা, দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে হন অবতীর্ণ।
ধর্মগ্রন্ত্রে নেই। বিষ্ণু পুরাণে পরিলক্ষিত হলেও অত্যন্ত পরিত্রভাবে তা প্রত্যক্ষগোচর। আদি রসাত্মক রূপে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অনেকটা দৃষ্ট হয় বটে, তবে জয়দেবের গীত গোবিন্দেই তার স্পষ্ট প্রকাশ। অতঃপর বাংলাভাষার কবি বড় চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি প্রমুখ এ ধরনের কাব্য অত্যন্ত যত্ন সহকারে করেছেন নির্মাণ। কিন্তু বড় চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি যেমন বৈষ্ণব কবি নন, তেমনি জয়দেবও নন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীভুক্ত কোনো ব্যক্তি। এমনকি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণত্ত নয় বিষ্ণু পুরাণের সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোনো গ্রন্থ। কাজেই বাংলার সাহিত্যিক কর্তৃক সৃষ্ট কৃষ্ণকে অনেকেই মনে করেন পূর্ববর্তী কৃষ্ণ অপেক্ষা ভিন্ন বা স্বতন্ত্র।১
গবেষক সমালোচকদের এই ধারণা সম্ভবত ভ্রান্ত নয়; মহাভারত গীতায় বর্ণিত কৃষ্ণের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে চিত্রিত কৃষ্ণের এত বিশাল পার্থক্য যে; তাদের দুজনকে এক মনে করা সত্যি ভীষণ কষ্টকর। যদি বাংলা সাহিত্যের আদিমধ্যযুগে বর্ণিত কৃষ্ণ নতুন কৃষ্ণ হয়ে থাকেন; কিংবা মহাভারত, গীতার কৃষ্ণই যদি এতদঞ্চলে স্থূলভাবে উপস্থাপিত হয়ে গ্রাম্যরূপ ধারণ করে থাকেন, তবে শ্রীচৈতন্য তাঁকেই দিয়েছেন আধ্যাত্মিক বা ঐশ্বরিক রূপ।
শ্রী চৈতন্যের আরাধ্য যে কৃষ্ণ; তিনি নন মহাভারতের কৃষ্ণ, এমনকি তিনি নন গীতারও কৃষ্ণ। রাধার সঙ্গে সম্পৃক্ত চঞ্চল কৃষ্ণ আসলে জয়দেবের কৃষ্ণ; বড়ু চণ্ডীদাসের কৃষ্ণ। বৈষ্ণবদের হাতে মার্জনা লাভ করে পববর্তীতে তিনিই হয়েছেন প্রেমিক কৃষ্ণ; পরমাত্মা কৃষ্ণ। গীতা, মহাভারত, ভাগবতের কৃষ্ণের সঙ্গে একীভূত হয়ে অতঃপর তিনিই হয়েছেন ভগবান কৃষ্ণ, অবতার কৃষ্ণ।
গীতায় কৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। আবার দুর্গতির চরম অবস্থায় তিনিই যুগে যুগে বিভিন্নরূপ ধারণ করে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন বলে উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনিই ঈশ্বর, তিনিই ব্রহ্মা- বিষ্ণু- মহেশ্বর- আবার তিনিই এদের সহ সমগ্র জগতের স্রষ্টা; আবার তিনিই বিষ্ণুর অবতার, তিনিই পার্থের সারথি, তিনিই কুরুক্ষেত্রের মহাবীর অর্জুনের গুরু বা শিক্ষক।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভক্তি। এর মাধ্যমে ভক্ত সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। এ সম্পর্ক অতীন্দ্রিয়, আর এ কারণে তা অনির্বচনীয়। বৈষ্ণবদের ভক্তি প্রেমকে ছয়টি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে।২ অবশ্য কেউ কেউ ব্রহ্মানন্দ স্তরকে বাদ দিয়ে একে পাঁচটি স্তরে করেছেন বিভক্ত।৩ স্তর সমূহ হচ্ছে-
১. ব্রহ্মানন্দ; ২. শান্তরতি; ৩. বাৎসরতি; ৪. দাস্যরতি; ৫. সখ্যরতি; ৬. মধুররতি
প্রথম স্তরের ভক্ত স্রষ্টাকে অতি প্রাকৃত রূপে কল্পনা করে তার ধ্যানে মগ্ন হন। দ্বিতীয় স্তরের ভক্ত স্রষ্টাকে চতুর্ভুজ নারায়ণ রূপে কল্পনা করে তাঁর পূজা অর্চনা করেন। তৃতীয় স্তরে কৃষ্ণ উপাসিত হন সন্তান রূপে। (যশোদার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক বাৎসরতি।) ৪র্থ স্তরে ভক্ত নিজেকে কৃষ্ণর দাস রূপে কল্পনা করেন। এ ক্ষেত্রে কৃষ্ণর প্রতি ভক্তের থাকে সীমাহীন শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম।
৫ম স্তরে ভক্ত হন কৃষ্ণের সাখা বা বন্ধু। এ ক্ষেত্রে স্রষ্টার প্রতি ভক্তের সম্ভ্রমবোধের হ্রাস ঘটে। ষষ্ঠস্তরে কৃষ্ণ ভক্তের প্রমিক। এ ক্ষেত্রে সম্ভ্রমবোধের পরিবর্তে প্রেম ও ভালবাসা পায় প্রাধান্য। বাংলাদেশে বিশেষত সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ৪র্থ থেকে ষষ্ঠ স্তরের ভক্তি প্রেমই স্পষ্ট ভাবে প্রত্যক্ষ হয়। সঙ্গীত এমনকি কীর্তন পালাতে ও এই রূপ সমূহই আমরা প্রত্যক্ষ করি বেশি।
ভারতীয় সাহিত্যে কৃষ্ণ নামে একাধিক চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে সকল কৃষ্ণই অভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এমনকি বৈদিক সাহিত্যের বিষ্ণু এবং পৌরাণিক নারায়ণও তার সাথে হন একীভূতো। সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিভিন্ন ব্যক্তির একই চরিত্রে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ কাহিনীর পরিধিই যে কেবল বৃদ্ধি পায় তা নয়; বিভিন্ন মতের সমন্বয়ে একটি বৃহৎ মতের সৃষ্টি হওয়ার পথও এতে হয় উন্মুক্ত।
যদিও বৈষ্ণব পদাবলী নাগরিক সাহিত্য; যদিও সমাজের উঁচু স্তরে ছিল এর চলন-বিকাশ; তথাপি লোকস্তরেও খানিকটা ভিন্ন আঙ্গিকে তা প্রত্যক্ষ হয়েছে। গীতি কবিতা ও লোকনাট্য উভয় আঙ্গিকেই এ ধারা ছিল অস্বাভাবিক জনপ্রিয়। উদাহরণ হিসেবে নিম্নে এর কয়েকটি উদ্ধৃত করা হলো।
১. রাধারমণ দত্ত (১৮৩৩ -১৯১১ মতান্তরে ১৯০৭) সুনামগঞ্জ
কালায় প্রাণটি নিল বাঁশিটি বাজাইয়া
আমারে যে কইরা গেল উদাসী বানাইয়া।
কে বাজাইয়া যাওরে বাঁশি রাজপথ দিয়া।
মনে হয় তার সঙ্গে যাইতাম কুলমান তেজিয়া।
অষ্ট আঙ্গুল বাশের বাঁশি মধ্যে-মধ্যে ছেদা।
নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি কলঙ্কিত রাধা ।
বাঁশিটি বাজাইয়া বন্ধে থৈল কদম তলে।
লিলুয়া বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
নিভিয়া ছিল মনের আগুন কে দিল জ্বালাইয়া ।
২. দেওয়ান হাসন রাজা (১৮৫৪-১৯২২) সুনামগঞ্জ
সোনা বন্ধে আমারে দেওয়ানা বানাইল।
দেওয়ানা বানাইল মোরে পাগল করিল
আরে না জানি কি মন্ত্র পড়ি যাদু করিল ॥
রূপের ঝলক দেখিয়া তার আমি হইলাম ফানা
সেই অবধি লাগল আমার শ্যাম পিরিতের টানা ।
কিবা ক্ষণে হইল আমার তার সঙ্গে দেখা
অংশীদার নাইরে তার সেত হয় একা ।
হাসন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা।
নাচে নুচে ফালায় ফুলায়, আর গায় গানা ॥
মুখ চাইয়া হাসে আমার, যত অরি পরি
দেখিয়াছি বন্ধের রূপ ভুলিতে না পারি ।
মন্দ সন্দ যাই বল, তার লাগিয়া নাডরি।
লাজ-লজ্জা ছাইরা বন্ধের থাকব চরণ ধরি ॥
দেওয়ানা হইয়া হাসন, কিসেতে কি বলে।
মার কাট যাই করে থাকব চরণ তলে ।
৩. দ্বীন ভবানন্দ আনুমানিক সপ্তদশ শতক, মৌলভী বাজার
কানাইরে তুই নন্দের ঘরে কালা
ছইওনা ছইওনা বা কালা ছইওনা রাঁধারে,
ছইলে কলঙ্গ রইব গোকুল নগরে । ধূয়া ॥
হস্তকালা পদকালা কালা মাথার কেশ,
হাটিতে সুন্দর কালা ধর নানান বেশ ।
দূরে থাকি বাজাও বাঁশি ঘরে বসি শুনি,
তোমার বাঁশীর রবে আমি বসিতে না পারি ।
দ্বীন ভবানন্দ বলে রাধালো শ্রীমতি
বিদেশে আনিয়া কালায় ভাঙ্গিল পীরিতি।
৪. দুর্বিন শাহ
নির্জন যমুনার জলে/বসিয়া কদম্ব তলে
বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যাম রায় ।
বাঁশিতে কি মধু ভরা/আমারে করিল সারা
আমি নারী ঘরে থাকা দায়-হায় গো-
কানাইর বাঁশি হলো বাম/বলে শুধু রাধার নাম
কুল বধূর কুল মান বাঁচায় ॥
বাঁশির সুরে অঙ্গ জ্বলে/ঘরের জল বাহিরে ফেলি
মনে লয় যাব যমুনার! হায় গো- শোন গো
ললিতা সখি/বন্ধু ছাড়া কেমনে থাকি
প্রাণ পাখি উড়িতে যে চায়।
আমি নারী কুল বালা/কানাইর বাঁশি দিল জ্বালা
অঙ্গ কালা বন্ধুর চিন্তায়।
যদি আমার কেউ না থাকে/বন্ধু এনে প্রাণটি রেখে
মন প্রাণ সঁপিব তার পায় ।
ভুবন মোহন সুরে/হায়গো নদী উজান ধরে
জ্বলে অনল আমার অন্তরায়।
মনে লয় সন্ন্যাসী হইয়া/দেখি তারে তল্লাসিয়া
কোন বনে সে বাঁশরি বাজায়।
নইলে কলসি বেন্ধে গলে/ঝাঁপ দিব যমুনার জলে
প্রাণটি দিব বলে দুর্বিন শায় ।
নবদ্বীপে বহু পূর্ব থেকে সিলেটবাসী পণ্ডিতদের অবস্থান ছিল; ফলে ওখানে সিলেটবাসীদের একটি পৃথক আবাসস্থল গড়ে উঠেছিল। উচ্চশিক্ষার জন্য মূলত তাঁরা সেখানে অবস্থান করতেন। অধ্যয়ন অন্তে এঁদের বৃহৎ অংশ পুনরায় সিলেটে ফিরে আসতেন এবং সম্ভবত সংস্কৃত ভাষাতেই সাহিত্যচর্চা করতেন। চৈতন্যের সময়ও তাঁর টোলে অনেক সিলেটবাসী ছাত্র ছিলেন।
তাঁরা শিক্ষা শেষে সিলেট প্রত্যাবর্তন করেন এবং চৈতন্য-মতবাদ প্রচারে ব্রতী হন। তবে চৈতন্যের মাহাত্ম্য ও মতবাদ বাংলাভাষী জনগণকে জ্ঞাত করার অভিপ্রায় ছিল বিধায় সংস্কৃতের পরিবর্তে বাংলাতেই তাঁরা তখন কাব্যচর্চা শুরু করেন।
বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ গ্রন্থে নবদ্বীপে শিক্ষা গ্রহণকারী কয়েকজন সিলেটবাসী কবির উল্লেখ পাওয়া যায়:
রত্নগর্ভ আচার্য বিখ্যাত তাঁর নাম।
প্রভুর পিতার সঙ্গে জন্ম এক গ্রাম ।
তিন পুত্র তাঁর কৃষপদ মকরন্দ।
কৃষানন্দ জীব যদুনাথ কবিচন্দ ।
শ্রীবাস পণ্ডিত আর শ্রীরাম পণ্ডিত।
শ্রী চন্দ্রশেখর দেব ত্রৈলক্য সুজিত ।
ভবরোগ নাশ বৈদ্য মুরারি নাম যার।
শ্রীহট্টে এসব বৈষ্ণব অবতার ।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নবদ্বীপের সুনাম ভারতব্যাপী ছিল বিধায় এমনিতেই সিলেটের কৃতী ছাত্রগণ নবদ্বীপে সমবেত হতেন। আর সিলেটবাসী পণ্ডিত জগন্নাথ মিশ্র এবং তাঁর পুত্র শ্রীচৈতন্য এ ক্ষেত্রে অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করলে সেখানকার প্রতি সিলেটবাসীর আগ্রহ অধিকতর বৃদ্ধি পায়। বিশেষত শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণব-মতবাদ বা নববৈষ্ণব মতবাদ প্রবর্তন করলে সিলেটের মানুষের মনে ভাবাবেগের প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়। এ জোয়ার কেবল নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষ এবং রাষ্ট্র, রাজ্য, পরগনাভেদে গোটা বাংলার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সৃষ্টি করেছিল মহাপ্লাবন। শ্রীচৈতন্য নিজে কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি; তাঁর আদর্শ ও মতবাদ শিষ্যগণই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রচার করে গেছেন। তবে তিনি বিভিন্ন স্থানে রাধা-কৃষ্ণের নাম-সংকীর্তন করতেন। এমনকি একবার তিনি সন্ন্যাসী অবস্থায় সিলেটও পদার্পণ করেছিলেন। যদিও তাঁর সিলেট পদার্পণের মূল উদ্দেশ্য ছিল পিতামহীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা; তথাপি সেখানেও তাঁকে নাম- সংকীর্তন করতে হয়েছে।
নবদ্বীপের টোল-প্রত্যাগত ছাত্র কর্তৃক সিলেটের জনগণ চৈতন্য ও নববৈষ্ণব মতবাদ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়ায় শ্রীচৈতন্যের আগমনে এখানেও প্রবল ভাবাবেগের সৃষ্টি হয়। ফলে সিলেট অঞ্চলেও তাঁর বিপুল শিষ্য ও ভক্ত-সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। চৈতন্য-মতবাদ কেবল সিলেটই নয়, সমগ্র বাংলার জনজীবনকে একসময় ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। ফলে বাংলার দর্শন, বাংলার সাহিত্য, বাংলার ধর্ম- সবকিছু এর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
আর সিলেটের কথা তো বলাই বাহুল্য, চৈতন্য-মতবাদের প্রভাবে সেখানে রাধা ও কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে এত বেশি সঙ্গীত রচিত হয়েছিল যে তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা কঠিন। কেবল সিলেটবাসী কবি কর্তৃকই শত-সহস্র পদাবলী-সঙ্গীত রচিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নিম্নে সিলেটের কবি গোলাম হোসেন (১৪৬৮-১৫৫৬) থেকে শুরু করে পীর আয়াত শাহ (১৮৭৭-১৯৩৮) পর্যন্ত বেশ কয়েকজন লোককবির একটি করে সঙ্গীত উদ্ধৃত করা হলো। এসব সঙ্গীত রাধা কৃষ্ণের উদ্ধৃতি যেন একেবারে অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল।
১. গোলাম হোসেন (১৪৬৮-১৫৫৬):
[মৌলভী বাজার জেলার লংলার অধিবাসী। নাগরীহরফে লেখা একটি পুথির মাধ্যমে তিনি আমাদের জানান যে, ১৪৬৮ ঈসায়ী সনে তার জন্ম এবং ৮১ বৎসর বয়স থেকে শুরু করেন কাব্য সাধনা।]
আবের পাতন ঘরে খাকের বদন
তার মাঝে খেলা করে শ্যাম নিরঞ্জন।
পবনে চালাইয়া দাগ আতসের পানি
রসের ঠিকুনি ঘর, মোমের গাঁথুনি।
তার মাঝে জুড়িয়াকে সুবইনের ফুল
পাতালে সে অত পাতি, স্বর্গে তার মূল।
দুই মুখে ফুটে ফুল ঘরে দীপ ম্বলে
প্রেম নিরখিয়া দেখ গোলাম হোসেন বলে।
২. দ্বীন ভবানন্দ (আনুমানিক সতেরো শতক):
[মৌলভীবাজার জেলাস্থ কুলাউড়ার লংলা পরগণায় জন্ম। তিনি সংসার ত্যাগী বৈষ্ণব ছিলেন। তার সুফিবাদের প্রতিও ছিলেন সমান শ্রদ্ধাশীল।।]
হেন কালে আসিয়া শ্রীমতি দিল বাঁধা। ধূয়া
হাটেতে যাইবার সখি মাথায় পশার
কোন ঘাটে দিয়া তুমি যমুনা হইবে পার।
খেয়া পাইবার গেলে পঞ্চমীর ঘাটে
পরম হরিষে যাইবায় মথুরার হাটে।
সেই ঘাটে খেওয়া দেয় বসিয়া কানাই
চল রসবতী সই তুমি আমি যাই ।
তোর মোর এক প্রাণ তনু মাত্র ভিন
শ্রীমতির সম্বাদ কহে ভবানন্দ দ্বীন ।
৩. সৈয়দ শাহানূর (১৭৩০-১৮৫৫):
মৌলভী বাজারের অধিবাসী বলেই অনেকের ধারণা, তিনিও সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন।]
আংখির নিকটে আছে আল্লা নিরঞ্জন
সামনে মানিক থইয়া, কেনে ভাঙ্গ বন
কাজল কোঠা ঘরর মাঝে
বইছইন কোন জন
দিল দরিয়ার মাঝে বসি
খেলে অনুক্ষণ।
লীলার রূপ চাইতে গেলু
ভুলিয়া আইলু রঙ্গে
কি রূপ দেখিনু আমি
কে যাইব মোর সঙ্গে।
যে বলে বন্ধের কথা
তার দিকে ধাই
মস্তকেতে হস্ত মারি
ভূমিতে লুটাই।
সুজনে সুজনের সাথে
পিরিত যদি করে
পিরিতি না ছাড়ে তারার
ডুবিলে সায়রে।
তন রাধা মন কানু
শাহানুরে বলে
রাধা কানুর মিলন হইল
আড়াই হাতের তলে ।
শাহানুরের তনে বলে
যদি লাগাল পাই
নিরলে বসিয়া রূপ
নয়ন ভরি চাই ।
৪. আব্দুল ওহাব (১৭৬৩-১৮৮৮, সিলেট): রাগ-বিরহ
চলরে চিকন কালা, সাজি চল মধুপুরে যাই। ধূয়া ॥
সাজ সাজ করিয়া বাঁশিতে দিল টান শুনিয়া অবলা রাধার উড়িয়াছে পরাণ কেমনে ছাড়িয়া বন্ধু যাইবায় এখন, শুনিয়া অবুলা করে ও কান্দন ।
মধুপুরে যাইবায় বন্ধু মোর পরানী লইয়া, কেবল শরীর ঘানি আমার ঠাঁইন থুইয়া ।
মুই যদি জান্তু বন্ধু তোর এই মতি, বিনা দড়াইয়া কেনে বাড়াইতু পীরিতি ॥
তোমার কথা বন্ধু বুঝিলু এখন সে যে অবুলা বাধা তেজিলু জীবন তুমি মধুপুরে যাইবায় বাশি দেও মোরে, তবে সে অবুলা রাধী বাঁচিতে পারি ঘরে ।
পদে ধরিয়া বন্ধু বুলি যেন তোরে, বাঁশি যদি না দেও সঙ্গে নেও মোরে।
বুঝিলাম কপট বন্ধু তোমায় এখনে, ছাড়িয়া যাইতে বুঝি লয় তোর মনে ।
ফকির ওহাব কহে, রাধে শুন দিয়া মন, রইবার নাহে বন্ধু; কান্দ কি কারণ?
৫. সুফি শীতালং শাহ (১৮০০-১৮৮৯): সিলেটের অধিবাসী।
শুন শুন সখি, সজনী রাই সয়না লো মোর প্রেমানল বন্ধুয়া ঘরে নাই ।
সখি গো, জ্বলে জ্বলে প্রেমানলে জ্বালা কত সই বন্ধু হারা, প্রাণ ছাড়া/কেমনে ঘরে রই ।
প্রেম ভিখারী শুন নাগরি ভষ্মধারী হই বন্ধু আস রাখ প্রাণ/শুন সজনী সই ॥
বন্ধুর আশা না পাই দিশা পন্থহারা হই।
পাইলে বন্ধু গুণ ইন্দু হিয়া কুঞ্জে মই ॥
দেখলে প্রিয়া ঠাণ্ডা হিয়া দুঃখ রবে নাই।
মরি আহা মরি রূপে পরান জুড়াই ।
মান-হারা, জনম-ভরা/কলঙ্কিনী হই প্রেমানলে দেহ জ্বলে/রসিক পাইলে কই ।
হিয়াটুটে, প্রাণ ফাটে/জ্বলে খাক হই আস গো ধনি গুণমনি/পদাশ্রয়ী হই।
শীতালং বলে অঙ্গে দোষ না গেল সই। পাইলে বন্ধু গুণসিন্ধু বিনয় করে কই ।
৬. পীর নাসিম আলী (১৮১৩-১৯২০): সিলেটের অধিবাসী।
কারে লইয়া কারে লইয়া বসতি করে মনারে রাধার মন্দিরে ।
কারে বাড়ি ঘর ভাই/তার নাইরে চিন ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখি, আপনার কুদিন।
সব কুল মজাইলায় মনা, না করিলায় হিত যত কিছু কর্ম করলায়, আপনার কু-চিত ।
( ওরে মনা) যার কাছে যাই আমি সেও তো বাসে ভিন
দেহার মাঝে পরম পতি, না পাই তার চিন ॥
(ওরে মনা) যোগীনির বেশ লইয়া ফিরি ঘরে ঘর
কে মোরে আনিয়া দিব রঙ্গের মনোহর ॥
পাইমু পাইমু করি মোর দিন তো যায় গইয়া কলিজায় লাগছে শেল, কে দিব খসাইয়া।
(ওরে মনা) অধম নাসিমে কয় দেখিতে বিকল
শূকনার মাঝে দেখি আমার
ভরা কৈলাম তল ॥
৭. করিম বক্স (উনবিংশ শতাব্দী):
[সুনামগঞ্জের অধিবাসী। তিনি হাসন রাজার শিষ্য বলে কথিত।]
সজনী গো, কে কদম তলায় বাঁশী বাজায় তার জন্য প্রাণ যায় জলদি মোরে আনিয়া দে ॥
সজনী গো আছম্বিতে বাঁশির ধ্বনি কর্ণের লাগাইছে অনুমানে বুঝি আমার বন্ধু আইসাছে ।
সজনী গো, বন্ধের লাগি মন বিবাগী আইনা দিবে কে আমার বন্ধু বিনে যায় কুলমান থাকবো কী সুখে ॥
সজনী গো, যদি বন্ধু আসে কূলে লইরব মনের সাধে কেবল করিম বক্সে চায় গো বন্ধু আইস্যা দেখা দে ।
৮ . ভেলা শাহ (উনবিংশ শতক): সিলেটের অধিবাসী।
প্রাণনাথ বন্ধু, আমি কত কতরে জ্বালা সইমু।
(ধূয়া) মনে ওঠে অনেক জ্বালা, কান্দি, শরীর কইলাম কালা ঘরে বৈরী ননদিনী রে ।
শাশুরি ননদী হইল বৈরী, ঘরের বাহির হৈতে না পারি লোকে বলে রাধা কলঙ্কিনী রে ।
দয়া কর শ্যাম কালা, সঙ্গে করি নেও অবলা আমি নারী পিরিতের মরা রে ॥
গোকুলের লোকে বলে আর, পিরিতি হইল গলার হার কেমনে বঞ্চিমু আমি ঘরেরে ।
ভেলা শাহ ফকিরে কয়, প্রেমের জ্বালায় তনু ক্ষয় বিচার করিয়া দেখ, কেও কেওরের নয় রে ।
৯. রাধারমণ দত্ত (১৮৩৩-১৯০৭) সুনামগঞ্জ: মূলত বৈষ্ণব সাধক, সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী।
মিছা কেন ডাক রে কোকিল মিছা কেন ডাক এগো ভাঙ্গিয়াছ রাধার বিছানা তোমরা সুখে থাক ।
আম ডালে থাকোরে কোকিল নিম ডালে বাসা এগো শূন্যে উড়, শূন্যে পড় তোমার কি তামাশা ।
অঙ্গ কালা বস্ত্র কালা শিরে জটা জটা এগো তে কেনে করিলাম পিরিত রাধা জিতে মরা ॥
স্থির কর মন গো রাধে
শান্ত কর মন এগো কাগজে আঁকিয়া কৃষ্ণ দেখাইমু এখন ॥
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া এগো আমি রাধা মরিয়া যাইমু কৃষ্ণ হারা হইয়া ॥
১০. হাজি মোহাম্মদ ইয়াসিন (১৮৪৯-১৯৩৪): [চুনারুঘাট হবিগঞ্জ। পরবর্তীতে ভারতের ত্রিপুরায় বসতি স্থাপন করেন।]
একজন সোনার মানুষ গো সই, সোনার মানুষ একজন সোনার মানুষ রূপের চাদ আমার আইসাছিল নদীয়ায়।
তার বিরহে অগ্নিবান লাগছে কলিজায় ।
সখিগো, তার রূপেরই কিরণ, সূর্যের বরণ মুখের আলো ঝলমল, অপূর্ব গঠন।
ও তার মিষ্ট হাসি গো সই মিষ্ট হাসি ও তার মিষ্ট হাসি, সর্বনাশী সৌদামিনী নমুনায় ।
সখি গো যে দেখলো তারে সে কি গো পারে লাজ কুলমান জ্ঞাতি গো জাতি রক্ষা করিবারে।
সে তো দিল-দেওয়ানা, নাই শান্তনা উদাসিনী হইয়া যায় ।
সখি গো আমি মরি গো মরি, উপায় কি করি প্রেমের জ্বালায় অঙ্গ জ্বলে কোন কলে তার।
আমার মাথার কিরা গো সই মাথার কিরা নয়ন-কিরা আমার বন্ধু আইনা দে আমার সখি গো ইয়া আলিপ আর সিনে বলে ঠেকিয়াছি কাল দেখাইয়া রূপের গো ছটা দুই পরি কালে।
এখন তার কারণে গো সই, তার কারণে এখন তার কারণে প্রাণ যায়।
১১. সহিফা বানু (১৮৫০-১৯১৭) : মতান্তরে (১৮৫৬-১৯০৭): সুনামগঞ্জ।
সুবল যারে বৃন্দাবন।
দেখে আসগে রাধারাণী আছেরে কেমন ।
মথুরাতে আছি আমি পাগল আমার মন।
রাধার জন্য সদা আমার প্রাণ উচাটন ॥
রাধার পদে ধরে সুবল করিস নিবেদন।
দিবানিশি রাধা প্যারী আছেরে স্মরণ ।
রাধার প্রেমে আছি বান্দা জন্মের মতন।
শীঘ্র গিয়ে দেখবো আমি ঐ রাঙ্গা চরণ ॥
মথুরাতে আছি আমি হইয়া রাজন।
রাধার খেদে ত্যাজ্য করবো রাজ্য সিংহাসন। সহিফায় বলে শুনো ভুবন মোহন কুজার কুবুদ্ধিয়ে তুমি হয়েছ বন্ধন ।
রাধার জন্য সদা আমার প্রাণ উচাটন ॥ রাধার পদে ধরে সুবল করিস নিবেদন
দিবানিশি রাধা প্যারী আছেরে স্মরণ
রাধার প্রেমে আছি বান্দা জন্মের মতন
শীঘ্র গিয়ে দেখবো আমি ঐ রাঙ্গা চরণ ॥ মথুরাতে আছি আমি হইয়া রাজন
রাধার খেদে ত্যাজ্য করবো রাজ্য সিংহাসন
সহিফায় বলে শুনো ভুবন মোহন কুজার কুবুদ্ধিয়ে তুমি হয়েছ বন্ধন
১২. সৈয়দ আব্দুনুর দীনহীন (১৮৫৪-১৯১৮):
বন্ধু রইলায়রে কোথায় অকুলে ভাসাইলায়রে নিঠুর শ্যামরায়। অকুলে ভাসাইলায় মোরের রাধার বন্ধু মোরে অন্নাথিনী কইলায়রে নিঠুর শ্যামরায় । জগত ঘোষণারে বন্ধু তোর পিরিতের দায় হায়রে তোর পিরিতের দায়।
ঘরে বাইরে লোকের মেলরে রাধার বন্ধু ঠেকাইলায় দায় রে ।
কার কাছে দাঁড়াইমুরে বন্ধুরে ডাকিব আয় হায়রে কে ডাকিব আয়।
কার কাছে মান করিমুরে ওহে রাধার বন্ধু দুঃখিনী রাধায় ।
দীনহীন বলেরে বন্ধু একি হইল দায় হায়রে একি হইল দায়
কৃপা কইরে যুগল চরণরে ওহে রাধার বন্ধু
দেও আমার মাথায় রে-
নিঠুর শ্যামরায় ।
১৩. দেওয়ান হাসন রাজা (১৮৫৪-১৯২২): দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মরমী কবি। সুনামগঞ্জ।
আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা
আমি তোমার কাঙ্গালী গো।
তোমার লাগিয়া কান্দিয়া ফিরে হাসন রাজা বাঙ্গালী গো।
তোমার প্রেমে হাসন রাজার মনে হুতাশন একবার আসি হৃদকমলে করয়ে আসন ॥
আইস আইস প্রাণ প্রিয়সী ধরি তোমার প্রায় তোমায় না দেখিলে আমার জুলিয়ে প্রাণ যায়
ছটফট করে হাসন তোমার কারণ ত্বরা করি না আসিলে হইবে মরণ
কান্দে কান্দে হাসন রাজা পড়ে আছাড় খাইয়া শীঘ্র করি প্রাণ প্রিয়সী, কোলে লও উঠাইয়া
কোলে লইলে ঠাণ্ডা হইব, হাসন রাজার হিয়া সব দুঃখ পাশরিব, চান্দমুখ দেখিয়া হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা রাধা বলিয়া ডাকিলে, মোল্লা মুন্সিয়ে দেয় বাধা
হাসন রাজা বলে আমি না রাখিব জুদা
মোল্লা মুন্সীর কথা যত সকলই বেহুদা
১৪. জহুরুল হোসেন (১৮৭৭-১৯৪):
স্থায়ী নিবাস হবিগঞ্জে; তবে পড়াশুনা করেছেন বামৈ, ময়মনসিংহ ও ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসায়।
প্রেমানলে অঙ্গ জ্বলে ভাবে ভাবে প্রাণ যায় ওলো রাই চল যাই নদীয়ায়
তমাল তরু চিকন কালা, বংশী স্বরে দ্বিগুন জ্বালা ঘরে অরি কুঞ্জরাণী, অঙ্গ জুড়ে বিষে ছায়
চল সখি দেখি জলে, কুম্ভ বাঁধ দিয়ে গলে নিদাগেতে দাগ লাগায়ে, চিত্তচোরা কোথা যায়
নদীটির স্রোত উজান চলে, জল ভরিও দমের কলে যতনে রাখিলে তারে, পূর্ণচন্দ্র দেখা যায়
এই নদীর নাই জোয়ার ভাটা সোজা রাখ মনের কাটা এক মনেতে দু’মন দিলে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়
কাল নদীতে গেল যারা সেই নদীর জল পায়না তারা চক্র খেলায় দিন কাটিয়ে বালিচোরা দেখতে পায়
১৫. মরিন উদ্দিন দৈখোরা (উনবিংশ শতক)
জন্ম নোয়াখালিতে। কর্ম ও শেষ জীবন অতিবাহিত হয় সিলেটে।
কী দেখিলাম যমুনার জলে গো ননদী রাই কী দেখিলাম যমুনার জলে।
অপরূপ অলিরাজ বিরাজ কমলে ॥ ননদী গো! মুই গেলু যমুনার জলে কলসী ভরিবার ছলে।
কী দেখিলাম যমুনার জলে গো ননদী রাই কী দেখিলাম যমুনার জলে ।
অপরূপ অলিরাজ বিরাজ কমলে ॥
ননদী গো! মুই গেলু যমুনার জলে কলসী ভরিবার ছলে
কী রূপ দেখিলু জলে।
জল অলি কমলে বসে কখন হাসে কখন ভাসে কখন লুকি দেয় গো জলে-গো ননদী রাই কলসী না গেল ভরা সঙ্গের সঙ্গী গেল তারা মুই অভাগী পড়ি রইলাম ভুলে।
ধরিতে না পারি তায়, ঠেকিলাম বিষম দায় যা ছিল মুই অভাগীর কপালে, গো ননদী রাই অলি ধরিবার ছলে, মুই নারী নামিলাম জলে তালাসিয়া পন্থ নাহি মিলে।
দুয়ারেতে তালা দিয়া, রাখছে পথ বন্ধ করিয়া খুলতে নারিনু কোন কলে গো ননদী রাই ।
অলি না আসিল আজ, দিন গেল হইল রাত কলসী ভাসাইয়া নিল জলে।
বৃথা কাজে দিন গওয়াইলু খালি হাতে ঘরে আইলু কী বলিমু পতি জিজ্ঞাসিলে।
পাগল দৈ খোরায় কয় শুনো ওগো রসময় মুর্শিদ ভজিলে পন্থ মিলে-গো ননদী রাই।
১৬. পীর আয়াত শাহ (১৮৭৭-১৯৩৮) সুনামগঞ্জের ছাতকের অধিবাসী।
সোনার গাছে কমল ধরা নদীর কুলে দেখা যায়
দেখ দেখ গো শ্যাম রায়
যে দেখিছে শ্যাম কমলা মৃত্যু নাই তার কোনো বেলা গো ওগো শ্যাম কমলা রসে ভরা বৃক্ষের উপর দেখা যায়
সোনার গাছে লাল কমলে ঝলোমলো সদায় করে গো ওগো তার ধারে হায়াত নদী দক্ষিণ অংশে সুলতান রায় ॥
পাগল আয়াতে বলে জলের মাঝে বন্ধু খেলে গো ওগো জরের মাঝে করে খেলা চাইয়া দেখ অষ্টগায়
১৭. মজির উদ্দিন: (উনবিংশ শতক; সুনামগঞ্জ)
এক নিরঞ্জন বিনে দুই নাহি আর আচার বিচার রুহু আঠারো হাজার ॥
হিন্দু বলে রাধা কৃষ্ণ, দেবতা তারার আমি ভাবি এই সবের নাহি দরকার ।
তন রাধা, মন কানু ভাবিয়া দেখ মনে রাধা কানু বিচারিয়া চাও আপন তনে ।
কানুর বাঁশি নাকের স্বর, লওরে বুঝিয়া তন রাধা সুন্দরী নারী, রূহুত কালিয়া ॥
বল বীর্য জ্ঞানবুদ্ধি এ সকল রাখাল রিপু ধেনু রাখালী করে সঙ্গেতে গোপাল ।
নাসা কর্ণ চক্ষু আদি সখিগণ রাধার ফকিরে বিচার কর তনে আপনার ॥
রাধা কানু মুখে বলে, মনে অন্যভাব কইন মজিরে বুঝতে পারলে গানে হয় লাভ ॥

এবং ক. মোঃ মতাহির আলী; সিলেট। (শ্যাম বন্ধুয়ার আড়ালে/ভাইসে উঠি নয়ন জলে ভবে আসি লাগছে ফাসি/ কান্দি বসি নিরলে)
খ. কবি মিয়াধন; মৌলভীবাজার (প্রেম সাগরে ভাসিয়া ফিরি যেমন সুতের শেওলা শ্যাম ছাড়া রাই কিশোরী কেমনে থাকইন একেলা)
গ. মুন্সী আশ্রফ আলী, সিলেট-আখালিয়া (দেখা দিয়া না দেও দেখা একি বিষম জ্বালা ঘরের বৈরি যৌবন পতি বাইরে চিকন কালা)
ঘ. মুন্সী হুছন আলী; সিলেট-জৈন্তাপুর (শ্যামচান্দ কালা-আমারে দিয়া জ্বালা অকূলে ভাসাইয়া চান্দ কার ঘরে গেলা)
ঙ. হাফিজ মোহাম্মদ হাতিম চৌধুরী (১৮৫৫-১৯২৫) সিলেট। (রসের বন্ধু কালাচান্দ, শিরমনি রাই বাউল পাগল হইয়া ক্রমিয়া বেড়াই)
প্রমুখ অসংখ্য কবি রাধা-কৃষ্ণ-গৌরাঙ্গ বিষয়ক সঙ্গীত রচনা করে এতদঞ্চলের মরমী সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে করেছেন সমৃদ্ধ।
সিলেটে আসাম্প্রদায়িক মরমী সঙ্গীতের ধারাটি অদ্যাবধি বহমান। এখনো অগণিত কবি এধারায় সঙ্গীত রচনা করে চলেছেন। গ্রন্থের শেষে এদের কয়েকজনের কয়েকটি সঙ্গীত উদ্ধৃত করা হলো।
উল্লেখ্য, বৈষ্ণব ভাবাপন্ন সঙ্গীত রচনা করলেও এঁদের সকলেই যে বৈষ্ণব কবি এমন নয়। মূলত অসাম্প্রদায়িক বলেই তাদের দ্বারা একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত রচনা করা হয়েছে সম্ভবপর।
বৈষ্ণব পদাবলীর লোকনাট্য অংশের নাম কীর্তন। এই কীর্তন আবার দুই প্রকার। যথা-নামকীর্তন ও পালাকীর্তন।
নামকীর্তনে কৃষ্ণের কেবল নাম উচ্চারণ করা হয়।
যেমন- হরে কষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে ।
পক্ষান্তরে পালাকীর্তনে কৃষ্ণ বা চৈতন্য কেন্দ্রিক বিভিন্ন কাহিনী হয় উপস্থাপিত। উভয় প্রকার কীর্তনই বিরামহীন ভাবে অষ্টপ্রহর বা ষোল প্রহর যাবৎ উৎযাপিত হতে পারে। অবশ্য ইদানিং কোনো কোনো দলকে ২/৩ ঘন্টা সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি কাহিনী উপস্থাপন করতে দেখা যায়। ভারতবর্ষে কীর্তনের ইতিহাস সুপ্রাচীন।৫ তবে বাংলা ভাষায় এর উৎপত্তি ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দির গোড়ায় দিকে বড় চণ্ডীদাসের হাতে ভারতের কোনো কোনো স্থানে অবশ্য একক কণ্ঠের গানকেও কীর্তন বলে।৬
কিন্তু বাংলায় কয়েকজন শিল্পি কর্তৃক নির্দিষ্ট তাল, লয়, সুর ও রীতিতে পরিবেশিত কৃষ্ণ বা চৈতন্যের কাহিনী ভিত্তিক সঙ্গীত কীর্তন হিসেবে বিবেচিত হয়।৭ কালী বা শ্যামাকে কেন্দ্র করেও ভক্তিমূলক কীর্তন রচিত হয়েছে, তবে তা পরবর্তীকালে। বৈষ্ণব কীর্তনের সূত্রপাত ত্রয়োদশ চতুদর্শ শতকে অপভ্রংশ অবহট্ট ভাষায় রচিত রাধা কৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলী থেকে।৮
বড় চণ্ডীদাস এই পদকর্তাদের অন্যতম; তবে চৈতন্য কর্তৃক দাক্ষিণাত্যে আবিষ্কৃত লোককবি লীলাশুকের ‘শ্রীকৃষ্ণকর্ণামৃতম’ এবং মিথিলার কবি বিদ্যাপতির পদসমূহ এই কীর্তনের রস ও ভাবের পরিবর্তন সাধনে প্রভাবিত করে থাকবে। উল্লেখ্য, চৈতন্যপূর্বকালে কীর্তন ছিল গণবিনোদনের মাধ্যম; এতে ভক্তিভাব ছিল সামান্য। কিন্তু চৈতন্য একে ভক্তি প্রবাহের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম রূপে ব্যবহার করেন।
প্রথমদিকে কীর্তন কেবল রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক কাহিনীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে তা চৈতন্য পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে রাধা-কৃষ্ণ অপেক্ষা চৈতন্য বিষয়ক লোকনাট্যই অধিক জনপ্রিয়। কীর্তনের অঙ্গ পাঁচটি। যথা: কথা, দোঁহা, আখর, তুক ও ছুট। ১০
তবে কেউ কেউ দোঁহার পরিবর্তে ঝুমুরকে এর একটি অঙ্গ বলে মনে করেন।১১ কথা বলা হয় মূলত সঙ্গীতের ভাষাকে। এই ভাষা গীতাদির মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র রক্ষা করে। তবে কীর্তনীয়া যখন গানের কোনো অংশের অর্থ বিশ্লেষণ করে বোঝান তখন তাকেও কথা বলে।
শ্লোকপ্রতিম রচনা হচ্ছে দোঁহা। এগুলো কীর্তনীয়া আবৃত্তি করে থাকেন। কীর্তনের বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে এর উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। আখরকে কথার তান বলা হয়ে থাকে। পদ পরিবেশনের সময় কীর্তনীয়া স্থানে স্থানে পদবাহিত ভাবকে অবলম্বন করে যে স্বরচিত ছন্দোবদ্ধ বাক্য পরিবেশন করেন তা-ই আখর। অনুপ্রাসবহুল, ছন্দোময়, মিলনাত্মক গাথা হচ্ছে তুক। এগুলোও কীর্তনীয়া নিজে রচনা করে মূল গানের সঙ্গে যুক্ত করেন।
ছুট মানে হচ্ছে পদের অংশ। সম্পূর্ণ পদ পরিবেশন না করে এর অংশ বিশেষ ছোটো তালে গাইলে তাকে ছুট বলে। ঝুমুর মিলনাত্মক গান। একই পালায় দু’দল মিলনের যে গান গায়, তাই ঝুমুর। লীলাকীর্তনের পরিবেশনরীতির ধারা প্রধানত দুটি। একটি পশ্চিমবঙ্গীয়, অন্যটি পূর্ববঙ্গীয়। পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা আবার পাঁচ রকমের। এগুলো হচ্ছে-গড়ান বা গড়ের হাটি, রেণেটি বা রাণীহাটি, মনোহরশাহী, মন্দারিণীও ঝাড়খণ্ডী। ১২
তবে ধারাসমূহের মিশ্রণ ও বিভিন্ন লোকসুরের প্রভাবে একসময় বেশ কিছু লোকধারারও প্রচলন ঘটে। বরিশাল, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে সৃষ্ট এই ধারাগুলোর নাম পূর্ববঙ্গীয় ধারা। পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা সমূহের মধ্যে আদি ও অকৃত্রিম ধারাটির নাম গড়েরহাটি। ১৩ রাজশাহীর গড়ের হাট পরগণাতে এ ধারার উৎপত্তি। সুর ও পরিবেশনরীতির দিক থেকে তা খুবই উচ্চাঙ্গের।
কিন্তু গায়ন পদ্ধতি জটিল হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। নরোত্তম ঠাকুর এধারার স্রষ্টা। বর্ধমান জেলার দেবীপুর রাণীহাটি পরগণায় উৎপন্ন ধারাটির নাম রাণীহাটি। বিপ্রদাস ঘোষ নামক জনৈক প্রসিদ্ধ কীর্তনীয়া এর জনক । ১৪ এ ধারা পূর্বোক্ত ধারা অপেক্ষা কিঞ্চিত সরল।
মন্দারিণী রাণীহাটি ধারার চেয়েও সরল একটি ধারা। এ ধারার নামকরণ স্থানের নামের পরিবর্তে রচয়িতার নামে হয়েছে বলে মনে করা হয়। উল্লেখ্য সরকার মন্দারণ নামক কোনো এক কীর্তনীয়া উক্ত ধারার স্রষ্টা। ১৫ তবে কেউ কেউ বংশীবদন নামক কীর্তনীয়ার নামও উল্লেখ করে থাকেন। ১৬
মনোহরশহী বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় একটি ধারা। বর্ধমানের বীরভূম, নদীয়া, মুর্শিদাবাদের সঙ্গম স্থল এর উৎপত্তিস্থান। মনোহর দাস নামক জনৈক কীর্তনীয়া উক্ত ধারা সৃষ্টি করেছিলেন বলে কারো কারো ধারণা। ১৭ তবে এ মতের বিপক্ষও প্রচুর মত বর্তমান।১৮
অনেকের মতে মনোহরশাহী ধারার উৎপত্তি কোনো ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক সাধিত হয়নি। নরোত্তম ঠাকুরের প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব সম্মেলনে উপস্থাপিত গড়ানহাটি ধারা থেকেই এধারার উৎপত্তি। উল্লেখ্য রাজশাহীর খেতুরী অঞ্চলের জমিদার তনয় সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞ নরোত্তম ঠাকুর ওরফে নরোত্তম দাস ঠাকুর বৃন্দাবন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর একটি বিরাট বৈষ্ণব সম্মেলনের আয়োজন করেন। তাতে খ্যাতনামা বৈষ্ণব সাধক, গায়ক, ও দার্শনিকদের আগমন ঘটে।
এই সম্মেলনে তিনি যে পদ্ধতিতে লীলাকীর্তন উপস্থাপন করেন তা সর্বসম্মতিক্রমে কেবল গৃহীতই হয়নি উচ্চ মর্যদায় প্রশংসিতও হয়। গড়ানহাটি নামক এই ধারাটিকে আরো জনপ্রিয় ও সরল করার অভিপ্রায়ে তৎকালীন সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতবর্গ সম্মিলিতভাবে যে ধারার জন্ম দেন তার-ই মনোহরশাহী ধারা। ১৯
ঝাড়খণ্ডী লীলাকীর্তন একটি লোকধারা; এ ধারা ঝাড়খণ্ডের লোকসুর ও রীতির মিশ্রণে সৃষ্ট। ২০ চৈতন্যের ভক্তি প্রেমের ধর্ম সেখানকার রাজা, জমিদার থেকে শুরু করে আদিবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তার করলে এতদঞ্চলের সাহিত্য সঙ্গীতের উপরও তার প্রভাব পড়ে। ২১ বিশেষত চৈতন্যের পদব্রজে ঝাড়খণ্ড হয়ে নবদ্বীপ যাতায়াতের কারণে সেখানকার আঞ্চলিক সঙ্গীত ধারাও চৈতন্যের কীর্তন ধারায় প্রভাবিত হয়। বৈষ্ণবকীর্তন ও স্থানীয় লোক সুরের প্রভাবে ক্রমে সৃষ্টি হয় ঝাড়খণ্ডীকীর্তনধারা। ঝাড়খণ্ডের গোপীবল্লভপুর, রোহিণী ঝাড়গ্রাম, বিষ্ণুপুর প্রভৃতি অঞ্চল ছিল এ জাতীয় সঙ্গীতের মূল কেন্দ্রস্থল।
বাংলাদেশে কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ধারাটির নাম পূর্ববঙ্গীয় ধারা। এ ধারা পূর্বোক্ত ধারা থেকে উদ্ভূত হলেও স্থানীয় সুর ও রীতির কারণে আঞ্চলিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। নিম্নে পূর্ববঙ্গের সিলেট- ময়মনসিংহ ধারায় প্রচলিত কীর্তনসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

সিলেট-ময়মনসিংহ ধারার কীর্তন
নবদ্বীপ প্রত্যাগত সিলেটবাসী ভক্ত ও পার্ষদ কর্তৃক সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে কীর্তনের সূত্রপাত ঘটার পর অর্ধ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় অবিকৃতভাবেই তা এতদঞ্চলে উপস্থাপিত হয়। তবে প্রায় একই সঙ্গে সাধারণ ভক্ত সম্প্রদায় কর্তৃক একটি লোকধারারও প্রচলন ঘটে। উভয় ধারার মিশ্রণ বা সমন্বয়ে সৃষ্ট লীলাকীর্তনের একটি ধারা গোস্বামী ও বর্ণ হিন্দু কর্তৃক নিকট অতীত পর্যন্ত সিলেট শহর ও তার পাশ্ববর্তী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উৎসবে উপস্থাপিত হয়েছে।
মৌলবীবাজারের রমণীমোহন গোস্বামী, সিলেটের মদনমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শ্রী প্রমোদচন্দ্র গোস্বামী, লামাবাজারের শ্যামসুন্দর আখড়াস্থ খোকা গোস্বামী, অনিল কুমার দত্ত প্রমুখ এ ধারার সর্বশেষ কৃতী গায়ক। তবে পূর্ব বাংলার লোকসুরের প্রভাবে সৃষ্ট কীর্তনের ভিন্ন ধারা সমাজের সাধারণ স্তরে, বিশেষত ভাটি বাংলায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পায়।
গোষ্ঠ, ঢপ, ঘাটু প্রভৃতি নামে পরিচিতি এ ধারার গত শতাব্দীর কুশলী কীর্তনীয়ার মধ্যে সুনামগঞ্জের মুকুন্দ চন্দ, নেত্রকোনার মুকুন্দ দাস, দিরাইর অনিল চন্দ্র দাশ, হবিগঞ্জের খুকুমণি দেবনাথ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অবশ্য গোস্বামী সম্প্রদায় কেবল ধর্মীয় উৎসবে তাদের কীর্তন পরিবেশন করতেন বিধায় এর পুরোটাই ছিল ভক্তিরস সমৃদ্ধ।
পক্ষান্তরে লোকস্তরে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়াশীল থাকায় ঢপ, ঘাটু প্রভৃতি কীর্তনে আদিরস উপস্থাপিত হতো নিয়মিত। ভক্তিমূলক কীর্তনের জলদ অংশে মহিলা দর্শকদের উচ্চস্বরে উচ্চারিত উলুধ্বনি; খোল- করতাল, বেহালা-মন্দিরা, হারমোনিয়ম-বাঁশির সুরের সঙ্গে এক অনির্বচনীয় ঐকতান গড়ে তুলতো।
এহেন আবেগঘন পরিবেশে ভক্তদের ভাবাবেগজনিত আনন্দাশ্রুপাত, পরস্পর মাল্য বিনিময়, ভূমিতলে পতিত হয়ে গড়াগড়ি বা মূর্ছা যাওয়া প্রভৃতি কীর্তনের সামগ্রিক অঙ্গ হিসেবে মর্যাদা পায়। কৃষ্ণ ও গৌরলীলা নামে পরিচিতি এই লীলাকীর্তনসমূহের বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশনরীতি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো
ক. কৃষ্ণ লীলা:
(১) ঢপ: বাংলার পালা কীর্তনের ধারা থেকে সৃষ্ট একপ্রকার লোকনাট্য হচ্ছে ঢপ। ২২ এই কীর্তন মধ্যযুগের বাংলা নাট্যরীতির অংশ। এতে কাহিনী আছে, পাত্র-পাত্রী আছে, আবার সঙ্গীতাশ্রয়ী নৃত্যাভিনয়ও আছে। তবে গায়নরীতির দিক থেকে তা কীর্তনের ধারা থেকে যথেষ্ট স্বতন্ত্র। খেয়াল, টপ্পা এবং ঠুংরির প্রভাব ঢপ কীর্তনে বর্তমান। বিশেষত টপ্পার বিস্তার ও অলঙ্করণ পদ্ধতি ঢপ কীর্তনে বিপুল ভাবে অনুসৃত হয়েছে।
কিন্তু তারপরও এগুলোর সবকিছু থেকে ঢপ স্বতন্ত্র। কারণ, কীর্তনের মতো আখরের ব্যবহার ঢপ কীতনে নেই এবং এর পদে অনুপ্রাসের প্রয়োগ অত্যধিক। এতদ্ব্যতীত প্রথাগত কীর্তনের সুরের সঙ্গে পদাবলী, পাঁচালী সহ কিছু সহজ ও চটুল সুর সংযোজিত হওয়ায় এর মেজাজ অনেকংশে হালকা। ২৩ বনগ্রাম মহকুমার অন্তর্গত গোপালনগর নিবাসী মোহন দাস বৈরাগী ঢপের একটি ভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন।
তিনি ছুট বা ছড়া গানের আকারে ঢপ গান রচনা করেন। এ ধরনের গানে বিভিন্ন ধরনের শব্দানুপ্রাস এবং রাগ- রাগিনীর সুর বর্তমান। মধুকানও এধরনের রচনা পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছিলেন বলে কারো কারো ধারণা। ২৪ বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের লেখক সিলেট অঞ্চলে যে ঢপকীর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন তাতে লক্ষ্য করা গেছে একেবারে গোড়াতেই হারমোনিয়ম, খোল, সানাই, মন্দিরা ও বাঁশি সহযোগে একটা জমজমাট যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ২৫ যাত্রা গানের অনুরূপ ৮/১০ মিনিট বাদ্য-বাজনার পর একজন মহিলা উপবিষ্ট অবস্থায় হারমোনিয়ম সহযোগে বন্দনা সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
ধীর লয় ও লম্বা লম্বা টানে উক্ত শিল্পী ও সহযোগীদের পরিবেশিত বন্দনা সঙ্গীতটির পরিবেশনরীতিতে কীর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। অবশ্য লোফা, ঝাঁপ, চঞ্চুপট, আদ্ধা প্রভৃতি তাল, সখীরে বলে চড়া সুরের বিস্তার, আর অভিনব পদ্ধতিতে মিউজিক cocert-এর মতো হারমোনিয়ম, বেহালা, ক্ল্যারিওনেট, করতাল প্রভৃতির একসঙ্গে বেজে ওঠা এ সঙ্গীতের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
মহিলাটি হারমোনিয়ম বাজিয়ে সঙ্গীত পরিবেশনের পর মঞ্চে সূত্রধারের আগমন ঘটে। বাদ্যযন্ত্রের সুর ও তালে তালে আগত সূত্রধার প্রথমেই দর্শকদের উদ্দেশ্যে ভূমিষ্ট প্রণাম জানান। অতঃপর ধীরে ধীরে দণ্ডায়মান হয়ে করজোড় অবস্থায় দর্শকদের উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে বলে ওঠেন-
আমরা কয়েকজন সাধারণ বালক সম্মিলিত হয়ে আপনাদের কাছে এসে উপস্থিত হয়েছি হরির গুণকীর্তন করতে। হরির গুণকীর্তন করে আমরা যে আপনাদের সন্তুষ্ট করবো, সেই ক্ষমতা আমাদের নাই। কারণ, আমরা অজ্ঞান, অধম, ধর্ম ও বিদ্যাহীন। তবু ভক্ত সাধারণের পদধূলি শিরে ধারণ করে আজ আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি হরির গুণকীর্তন করবার জন্য। হরির গুণকীর্তন করতে আমাদের অনেক ভুল ত্রুটি হতে পারে। এ বিষয়টি আপনারা আপনাদের নিজ গুণ ও মাহত্ম্যে মার্জনা করে দেবেন।
আজ আমরা যে কীর্তন আরম্ভ করতে মনস্থ করেছি, তার নাম ‘নৌকা বিলাস’।-‘নৌ-কা বি-লাস’। নৌকাবিলাস অভিনয় করতে আমাদের অনেক ভুল ত্রুটি হতে পারে। এ ভুলের সব দায় আমাদের। আর যেটুকু ভালো লাগবে তা হরি ও আপনাদের আর্শীবাদ বলে মনে করবো। আপনাদের সবাইকে জানাই আবারো প্রণাম। ‘২৬
এই উক্তির অন্তে মহিলা সূত্রধারের প্রস্থান ঘটে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আগমন ঘটে কৃষ্ণরূপ ধারী এক যুবকের।
যাত্রাগানের রাজার পোশাকের ন্যায় কালো বর্ণের লম্বা জামা ও সরু মুকুট পরিহিত কৃষ্ণ মঞ্চে এসেই বলে ওঠেন-আমার মনটা আজ উতলা কেন বাশি, তুই কি তা বলতে পারিস? এই বাঁশি বলনা। কিছুক্ষণ বাঁশিটি নাড়াচাড়া করার পর একসময় তিনি এতে সুর তোলেন। বাঁশির সুরে ৪/৫ মিনিট কেটে যাওয়ার পর তিনি দর্শকের উদ্দেশ্যে বলেন-মন আমার উতলা হবেনা কেন, রাধা যে আমায় স্মরণ করছে। ‘ও রাধা তুমি কোথায় আছো, আমার যে তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে’ এই বলে তিনি একটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পূর্ববৎ লম্বা টান ও ধীর লয়ে শুরু হওয়া সঙ্গীতটি অবশ্য শেষের দিকে একই তালে জলদ হয়ে ওঠে এবং এই অবস্থাতেই পরিণতি পায়।

বাজনার মৃদু সুর চলন্ত অবস্থায় কৃষ্ণ তখন ধীর লয় কিন্তু সুউচ্চ স্বরে বলেন-আজ আমার শ্রীমতীর সঙ্গে ঐ যমুনার শীতল সলিলে মিলন করতে হবে (মিলিত হতে হবে), আজ তাহলে আমি এখন যাই, দেখি আমার শ্রীমতি কেমন আছে বা কী করছে?
বাক্যটি শেষ হওয়ার পর কৃষ্ণ প্রস্থান করেন, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র থাকে চলমান এবং তা পূর্বাপেক্ষা অনেক দ্রুত ও উচ্চ স্বরে। তন্মধ্যে বাঁশির সুরটাই অধিক স্পষ্ট ও জোড়ালো হয়ে ওঠে।
এ অবস্থাতেই আকর্ষণীয় পোশাক পরিহিতা রাধা ও সখির প্রবেশ ঘটে।
রাধা : সখিরে সখি, তুই শুনতে পাচ্ছিস?
সখি : না তো।
রাধা : কী বলছিস, তুই কিছু শুনতে পাচ্ছিস না?
সখি : আমিতো বলছি আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিনা।
রাধা : তাহলে তোর কানটা বাজে হয়ে গেছে।
সখি : ওমা; আমার হয়েছে বাজে কান, আর তোমার খুব ভালো কান, তাইনা? আচ্ছা বলতো তুই কী শুনতে পাচ্ছিস?
রাধা : কালা যে বাঁশিতে আমায় ডাকছে।
সখি সহাস্যে : ও এই কথা? আমরা কি তবে কান চেপে ধরেছি?
রাধা : সখিরে, তাহলে আমি বলছি; তুই শোন। বাঁশি বাজে কানে বাজেনা। (গান) দোহার-বাঁশি বাজে কানে বাজেনা। (এরূপ ৫/৬ বার)
রাধা : ভালো কানে বাজে বাঁশি, বাজে কানে বাজেনা।
দোহার : ভালো কানে বাজে বাঁশি, বাজে কানে বাজেনা।
এভাবে গানটি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ৫/৬ মিনিট পর শেষ হয়। গানের মূল বক্তব্য হচ্ছে-উন্নত মানের কান ও কৃষ্ণানুরাগী না হলে কৃষ্ণের বাঁশির সুর ও তার মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়না। সখিরা তাই কৃষ্ণের বাঁশির সুর শুনতে পায়না। গানটি শেষ হলে আবারো সংলাপ শুরু হয়। ওরে সখি, তোকে আমরা সেদিনই বারণ করেছিলাম; বলেছিলাম ওরে যাসনে যাসনে কদম তলে। কিন্তু তুই তো সেদিন শুনলিনা আমাদের কথা। ওখানে যাওয়াতেই আজ তোর এই দশা।
-সখি, শুধু শুধু আমার উপর দোষ দিচ্ছিস কেন? তোরাই তো প্রাণ গোবিন্দের সঙ্গে আমায় সাক্ষাৎ করিয়ে দিলি।
-কীভাবে?
-তোরা আমাকে সেদিন একা ফেলে চলে গিয়েছিলি না।
-ও এই কথা? তোর শাশুড়ি যদি তোকে আমাদের সঙ্গে দেখে ফেলেন এই ভয়েইতো আমরা তোকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলাম।
-আর ঐসময়ইযে প্রাণচোরা কালাকানাই এসে উপস্থিত হলো। সখিরে- বলে এসময় একটি গান গেয়ে ওঠেন একজন সখি। পরে রাধা তার উত্তরে আর একটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
এভাবে গান-বাজনা-সংলাপের মধ্যদিয়ে কাহিনী এগিয়ে যায়। কিন্তু রাধা কোনো ভাবেই তার শাশুড়ি ও ননদিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে যমুনার ঘাটে যেতে পারেন না। দীর্ঘ তিন ঘন্টা যাবৎ নানা ছল চাতুরির আশ্রয় নেয়ার পরও যখন যমুনার ঘাটে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিলনা, তখন সখিরা সুকৌশলে তাকে কৃষ্ণের কাছে নিয়ে যায় এবং নৌকায় ঘটে মিলন। বাদ্য-বাজনা-গানে এর পর একটা ভীষণ জমজমাট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং রাধা ও কৃষ্ণ একে অন্যের হাত উর্ধমুখে তুলে ধরে নৃত্য করতে থাকেন। এভাবেই পালাটির সমাপ্তি ঘটে।
কালী মণ্ডপের সম্মুখ প্রাঙ্গনের মেঝেতে মাদুরে উপস্থাপিত কীর্তনটি রাত ১২টার দিকে শুরু হয়ে ভোর ৫ টায় শেষ হয়। রাধা ব্যতীত অন্যান্য অভিনেতা পুরুষ ছিলেন। তবে চরিত্রের প্রয়োজনেই কৃষ্ণ ব্যতীত অন্যেরা নারী সাজে সজ্জিতা হয়েছেন। তাদের কন্ঠ ও সাজ-সজ্জার গুণে অবশ্য বোঝার উপায় ছিলনা যে, এরা প্রকৃতপক্ষে পুরুষ অভিনেতা।
শ্যামা পূজা উপলক্ষে সিলেটের ভাটি অঞ্চলের একটি সংগঠন২৭ এই অনুষ্ঠানের অয়োজন করেছিল। ভূমিসমতল বৃত্তাকার মঞ্চের চতুর্দিকে প্রায় দুই সহস্রাধিক দর্শক তা উপভোগ করেন।
মধ্যযুগে সিলেট জেলায় ঢপ কীর্তনের বহুল প্রচলন ছিল। সম্ভবত নবদ্বীপ থেকে চৈতন্যের ভক্ত ও শিষ্য সম্প্রদায় কর্তৃক সিলেট অঞ্চলে তা প্রচারিত হয়েছে। তবে বর্তমানে এতদঞ্চলে এই রীতির প্রচলন কম। সুনামগঞ্জ জেলাস্থ দিরাই উপজেলার লোল্লার চর এবং শাল্লা উপজেলার আননপুরের কয়েকজন কীর্তনীয়া মাঝে মধ্যে প্রয়োজনে ঢপ পরিবেশন করেন।
অবশ্য প্রভাত বৈষ্ণব, মহিতোষ মাহিষ্য দাস, বিধান দাস প্রমুখ কয়েকজন কিশোরকেও এ, ধরনের সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে। এদের দ্বারা সঙ্গীতটি অন্তত আর একটি প্রজন্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস।
(২) গোষ্ঠগান: বালক কৃষ্ণের গো-চারণ লীলাকে কেন্দ্র করে নাট্যমূলক গোষ্ঠ গানের উদ্ভব। ২৮ এটি গ্রামীণ কৃষক সমাজের অতি অন্তরঙ্গ উৎসব গুলোর একটি। এ উৎসব সূর্যোদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলে এবং সর্বক্ষণই পরিবেশিত হতে থাকে বিভিন্ন ধরনের নৃত্য ও গীত।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বন্দনা অংশ। একে ‘উদয় বন্দনা’ বলা হয়ে থাকে। এ অংশের প্রথমে মূল গায়েন দু-একটি সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করেন এবং পরে বাংলা ভাষায় শুরু করেন কৃষ্ণ, রাধা, গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দের বন্দনা। ঐ সময় টুং টাং করে বেহালা বাদক তারে সুর বাঁধার চেষ্টা করেন এবং খোল ও এস্রাস বাদক সেই সুরে স্কেল ধরতে মনোযোগ দেন। যন্ত্রের সুর, পরিবেশন উপযোগী হয়ে উঠলে মূল গায়েন বন্দনা শেষ করে একটি রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
রে বন্ধু কানাই কালিয়া/হাতে লও মোহন বাঁশি ভব জ্বালা ছাড়িয়া ।
অরি সনে বনে গেলে সাজ কাজ অঙ্গে।
হাতেতে মোহন বাঁশি ধেনু পাল সঙ্গে।
অকস্মাৎ হইল তোমার মন বাউল একি
কাম সাগরে ঝাম্প দিলে ধেনু বেণু রাখি। …
বাওলা ও ধামাইলের মিশ্রণজাত সুরে এই সঙ্গীত পরিবেশনের পর পরই শুরু হয়ে যায় মূল অনুষ্ঠান। সঙ্গীত এবং অঙ্গভঙ্গীর মাধ্যমে এ পর্যায়ে কৃষ্ণের গো-চারণ মূলক গীতিনাট্যের সূত্রপাত ঘটে। অবশ্য এর আগে গৌরচন্দ্রিকা এবং কৃষ্ণের ননী চুরির কাহিনীও কোনো কোনো পালাকার উপস্থাপন করে থাকেন।
আমি তো না খাইছি ননী/খাইছে বলাইয়ে
আমি যদি খাইতাম গো ননী/থাকতো আদা ছাদা
এগো বলাইয়ে খাইছে ননী/ভাণ্ড করছে খাদা ।
মূল গায়েন এসময় কোনো একটি গানের দু’পংক্তি উচ্চারণ করেন আর এর অব্যবহতি পরেই সহযোগীগণ তাতে কণ্ঠ মেলান। গায়েন এরপর গদ্যেও কিছু অংশের ব্যাখ্যা দেন। তাল ও সুরযন্ত্র অবশ্য পূর্বের মতোই এ সময় বাজতে থাকে। সাদা ধূতি, হলুদ পাঞ্জাবি ও বৈষ্ণব নামাবলী পরিহিত গায়েনের এ ধরনের নৃত্যগীত চলতে থাকে দু’ থেকে তিন-ঘন্টা পর্যন্ত।
গোষ্ঠগানে গাভীকে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়। এই গাভীরা আবার শ্যামলী ও ধবলী নামে সম্বোধিত হয়।
ধবলী শ্যামলী বলে ডাকে/আয় শ্যামলী, আয় ধবলী
ডাকে তোমায় বনমালী/আয় শ্যামলী, আয় ধবলী ॥
সন্ধ্যার দিকে ফেরার প্রস্তুতি বিধায় সেই সময় গাওয়া হয় ‘ফেরৎ গোষ্ঠ’। ঘরে ফেরা উপলক্ষে পরিবেশিত এই সঙ্গীতের সুর খুবই শ্রুতিমধুর। এতদ্ব্যতীত মুদারা থেকে তারা সপ্তকে গাওয়া হয় বলে সুরটির তেজদীপ্ততাও উল্লেখ করার মতো। তিনটি দল পালা করে সারাদিন ব্যাপী এই পালা কীর্তন উপস্থাপন করে। সিলেট রামকৃষ্ণ মিশনে পরিবেশিত গোষ্ঠগানের পালাকারগণ পোশাক হিসেবে গেরুয়া বর্ণের বুক কাটা হাফশার্ট এবং শ্বেত বর্ণের ধূতি পরিধান করেছেন।
মূল পালাকারের পরিধানে অবশ্য হলুদ বর্ণের ফুল পাঞ্জাবি, আবীর বর্ণের ওড়না, সাদা শিল্কের ধূতি এবং ফিকে লাল বর্ণের কোমর বন্ধনী ছিল। গলায় রুদ্রাক্ষের বড় মালা এবং দক্ষিণ পদে বৃহদাকৃতির নূপুর শোভিত কীর্তনীয়া প্রায় সর্বক্ষণই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করেছেন। এদের প্রত্যেকের ললাট ও কপোল চন্দনের দৃষ্টি নন্দিত কারুকার্যে শোভিত ছিল।
গোষ্ঠগানের শুরুতে যে গৌরচন্দ্রিকা গাওয়া হয় তাও আকর্ষণীয়। প্রবন্ধ লেখকের বাসভবনে সুনামগঞ্জ জেলাস্থ দিরাই উপজেলার শ্যামার চর গ্রামের লোকনাথ সম্প্রদায় কর্তৃক যে গোষ্ঠগান উপস্থাপিত হয়, তার শুরুতে এমন আকর্ষণীয় গৌরচন্দ্রিকাই প্রত্যক্ষ করা গেছে।
উল্লেখ্য, ঐদিন কীর্তনীয়া দল প্রথমেই হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে বলে নাম কীর্তন উপহার দেন। পরে হারমোনিয়ম, খোল, মন্দিরা ও বাঁশি সহযোগে পরিবেশন করেন যন্ত্রসঙ্গীত। এরপর শুরু হয় বন্দনা। গুরু কৃপাহি বলো কেবল এই পঙক্তিটিই বিভিন্ন স্টাইলে দোহার ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে কীর্তনীয়া কয়েকবার পরিবেশন করেন। অতঃপর সংস্কৃতে উচ্চারণ করেন ‘অখণ্ড মণ্ডলাকারং ব্যাপ্ত যেন চরাচরং, তৎপদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ’ এই শ্লোকটি। ধূয়া হিসেবে তখনো গুরু কৃপাহি বলো উচ্চারিত হয়। এরপর বাংলায় শুরু হয় বন্দনা।

প্রথমে বন্দনা করি মাতাপিতার চরণ, দ্বিতীয়ে স্মরণ করি ওস্তাদের চরণ। সরস্বতীর চরণ বন্দি কণ্ঠে ধরি গান-ইত্যাদি। -এ অংশেরও ধূয়া-গুরু কৃপাহি বলো।
(অনেক পালাকারকে প্রথমে সরস্বতীর পদ বন্দনা করতে দেখা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে মাতা-পিতা ও ওস্তাদের স্থান হয়েছে পূর্বে।)
বন্দনার পর শুরু হয় বিনয় সম্ভাষণ। কীর্তনীয়া দর্শকদের উদ্দেশ্যে এসময় বলেন-
বলেন-
‘আমি অতি দূর মতি/না জানি সাধন রীতি তাই (তবু অর্থে) আজ আমি আপনাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েছি হরির গুণগান গাইবো বলে (চেতান)।
হরির গুণগান কী গাইবো বলুন? আমি বুদ্ধিহীন জন। তবু যখন আপনাদের সম্মুখে দাঁড়িয়েছি, আপনাদের চরণ মস্তকে নিয়েই শুরু করবো। হরির গুণকীর্তন গাইতে অনেক ভুল ত্রুটি হতে পারে। আপনারা ছোটো ভাই ও ছেলে মনে করে তা মার্জনা করে দেবেন।’ বিনয় সম্ভাষণ ঢপের অনুরূপ মনে হলেও কিছু সুস্পষ্ট পার্থক্য এতে দৃশ্যমান। ঢপ কীর্তনে যে সম্ভাষণ ছিল যাত্রার সংলাপের ন্যায়, গোষ্ঠগানে সেই সম্ভাষণই সঙ্গীতের মতো উচ্চারিত হয়েছে।
অবশ্য ঢপ কীর্তনে যাত্রার অনুরূপ পাত্র-পাত্রীও বর্তমান; কিন্তু গোষ্ঠগানে কোনো পাত্র-পাত্রী নেই, মূল কীর্তনীয়াই কখনো গদ্যে, কখনো পদ্যে কাহিনী উপস্থাপন করেন। গোষ্ঠগানের সংলাপও নিরেট গদ্য হয়না; সঙ্গীতের মতোই তা হয় গীতধর্মী। গৌরচন্দ্রিকার সূত্রপাত ঘটে তার পর। পালাকার বা মূল কীর্তনীয়ার ৩০ মতে, যে কোনো কৃষ্ণলীলা পরিবেশনের পূর্বে গৌরচন্দ্রিকা উপস্থাপন করতে হয়। তবে সময় স্বল্পতার কারণে আজকাল কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ অংশটি বাদ দেয়ারও প্রয়োজন পড়ছে। গৌরচন্দ্রিকাতেও যথারীতি কাহিনী থাকে। তবে এ কাহিনী চৈতন্য কেন্দ্রিক।
সঙ্গীত ও সংলাপের মাধ্যমে বর্ণিত কাহিনী নিম্নরূপ: গৌরাঙ্গ একদিন সুরধনীর তীরে হাঁটছেন, এমন সময় শুক ও সারি নামক দুটি পাখির কথাবার্তা শুনে তার পূর্বজন্মের কথা মনে পড়লো। তার স্মরণ হলো, রাধা প্রেমে একদা তিনি ভয়াবহ উন্মাদ ছিলেন; সবসময় তাঁর রাধার কথা মনে হতো। মনে পড়লো, একদা তিনি মধ্যাহ্নে গরু চড়াচ্ছেন এমন সময় রাধা বিরহে দারুণ ভাবে আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লেন।
সুবলকে একথা জানালে সুবল কৌশলে রাধার কাছে গেলেন। একজন পুরুষের নারী কুঞ্জে যাওয়া তখন বেশ কষ্ট সাধ্য ব্যাপার ছিল। তাই তাকে অনেক ছলনার মাধ্যমে সেখানে গমন করতে হয়েছে। রাধাকুঞ্জে তিনি দেখলেন, রাধাও কৃষ্ণ প্রেমে ব্যাকুল হয়ে আছেন। সুবল তাই রাধা সাজে সজ্জিত হয়ে রাধাকুঞ্জে বসলেন, আর রাধা সুবল সেজে কৃষ্ণের কাছে চলে আসলেন। গৌরসুন্দর একথা তাঁর এক ভক্তকে বলতে বলতেই গৌরচন্দ্রিকার সময় শেষ হয়ে আসে।
প্রভাত ও মধ্যাহ্নগোষ্ঠ তো বটেই, ফেরৎ গোষ্ঠেও গৌরচন্দ্রিকা গাওয়ার প্রচলন ছিল।
(৩) ঝুলন: ঝুলন রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমোৎসব। একে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মিলন উৎসবও বলা হয়ে থাকে। বৈষ্ণব বা কৃষ্ণ অনুসারীদের মধ্যে উক্ত উৎসব পালনের প্রবণতা অধিক হওয়ায় ‘আখড়া’ বা বৈষ্ণব আশ্রমগুলিতে এটি প্রত্যক্ষ হয় বেশি। সিলেট শহরের লামাবাজারস্থ শ্যাম সুন্দরের আখড়া, মির্জাজাঙালস্থ নিম্বার্ক আশ্রম, কাজল শাহস্থ যুগল টিলা আখড়া প্রভৃতি উপসনালয় ও তার আশেপাশের বাড়িতে অদ্যাবধি এই অনুষ্ঠানটি দেখা যায়। বর্তমানে অবশ্য সকল মন্দির বা উপাসনালয় এই সঙ্গীত বা পালার আয়োজন করেনা; বিশেষ বিশেষ মন্দিরেই কেবল মাঝে মধ্যে তা প্রত্যক্ষ হয়।
তবে ২০০৩ খ্রিস্টাব্দের ঝুলন উৎসবে যুগলটিয়ায় তিন দিন ব্যাপী পালা-কীর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার শিল্পীগণ পালা করে বিরামহীনভাবে কীর্তন পরিবেশন করেছেন। পূর্বে বনবৃক্ষের শাখায় বনলতা ও পাতা দ্বারা সজ্জিত একটি দোলনার মধ্যে কৃষ্ণ ও রাধাকে উপবেশন করিয়ে (মূর্তি বা মানুষ) ঝুলন যাত্রা উৎযাপিত হতো। বর্তমানে মন্দির বা আখড়াতে কাঠ বা ধাতু নির্মিত দোলনায় রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপন করে; তার চারপাশে বৃক্ষশাখা ও ফুল, এবং লতা-পাতা দ্বারা কৃত্রিম অরণ্য সৃষ্টি করে এই অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়।
ঝুলন সঙ্গীত পরিবেশনায় বিশেষ কোনো ধরনের পোশাকের ব্যবহার চোখে পড়েনা। ধৃতি-পাঞ্জাবি বা ধূতি-গেঞ্জি পরিধান করেই গায়কগণ কৃষ্ণলীলা উপস্থাপন করেন। তবে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে একটি বেহালা, একটি এসরাজ, দু’টি খোল, দু’টি মন্দিরা এবং একটি বাঁশি ব্যবহৃত হয়। ঝুলন পালার পরিবেশনরীতি গোষ্ঠগানের অনুরূপ।
তবে বিষয় হিসেবে রাধা-কৃষ্ণের মিলন কাহিনী প্রাধান্য পায়। এ কাহিনীতে কোনো ছলনার অংশ নেই; সখিরা কীভাবে ঝুলন কার্যের আয়োজন করবেন, আর কীভাবে রাধা ও কৃষ্ণকে সজ্জিত করবেন তারই বর্ণনা থাকে সম্পূর্ণটা জুড়ে। এ নাট্য পরিবেশনের জন্য একটি সুউচ্চ মঞ্চ থাকে এবং ভূমি সমান্তরাল এই মঞ্চের সম্মুখ প্রান্তেবসে দর্শক-শ্রোতাগণ পালা উপভোগ করেন।
গানগুলো মূলত দাদরা, তেওড়া ও কাহারবা তালে পরিবেশিত হয়। ফাগ সঙ্গীত ঝুলনের প্রায় অনুরূপ। তবে এই সঙ্গীত পরিবেশনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে অধিকাংশই সাত মাত্রার তেওড়া তাল এবং মধ্যম লয়ে শুরু হয়ে, পরবর্তীতে জলদ রূপ ধারণ করে এবং পুনরায় মধ্যম লয়ে ফিরে এসে আট মাত্রার কাহারবা তালে রূপান্তর লাভ করে। এসময় লয় দ্রুত হয় এবং দ্রুত লয়েই সঙ্গীতের সমাপ্তি ঘটে।
(৪) ঘাটু: চপ শ্রেণীর আর এক ধরনের উল্লেখযোগ্য নাট্যাভিনয় ‘ঘাটু’। এক সময় সিলেট অঞ্চলে তা খুবই জনপ্রিয় ছিল। উক্ত নাটকে একজন রাধা এবং অন্যজন কৃষ্ণ সাজে সজ্জিত হয়ে নাট্যাভিনয় করতেন। রাধার চরিত্রে সাধারণত অল্প বয়স্ক বালককে অভিনয় করানো হতো। দোহার ও বাদ্যযন্ত্রীগণ এক্ষেত্রে (একই মঞ্চে) কখনো দাঁড়িয়ে আবার কখনো বসে অভিনেতাদের সহায়তা করতেন।
ঘাটু গীত পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে শুরু করে ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে স্থান ভেদে তার নাম ছিল গাঁড়, গাটু, ঘাঁটু প্রভৃতি। বর্ষার দিগন্ত ব্যাপী হাওরের কূলে নৌকায় করে ঘাটে ঘাটে গান গাওয়া হতো বলে এর এ ধরনের নামকরণ বলে কেউ কেউ ধারণা করেন।৩১

এ সম্পর্কে আশরাফ সিদ্দিকী বলেন-
‘রাধার বিরহকে কেন্দ্র করেই ঘাটু গানের উৎপত্তি-গানগুলোও সংক্ষিপ্ত-দুই পদী বা তিন পদী। গায়কেরা এগুলোকে ‘দোহারী’ এবং ‘তিহারী’ বলেন। চম্পক অঙ্গুলি সঞ্চালন করে নৃত্যের ভঙ্গিমায় বর্ষা-মেদুর প্রকৃতির পটভূমিতে ঘাটু বালকের বিরহ সুর শ্রোতাদের তন্ময় করে তুলতো:
কি হেরিলাম যমুনায় আসিয়া গো সজনী
বনমালী তরুয়া মূলে।/যাইতে যমুনার জলে সেই কালা কদম তলে/ও রূপ চাইতে কলসী নিল স্রোতে । (সিলেট)
ঘাটু গানের এক পর্যায়কে তেলেনা বলা হয়। এতে উর্দু ও হিন্দীর মিশ্রণ থাকে।
পিয়ারী তোমকো পিত লাগাওয়ে,
রুম ঝুম্ ঝুম্ তানা নানা নাছ নাছ ।
স্পষ্টই মনে হয় নাচের জন্যই গানটি রচিত । (সিলেট) বিভিন্ন বিরহ-সংগীতের অশ্রুধারা দিয়ে তৈরি হলেও লোক-সাহিত্যের চিরাচরিত নিয়তিকে ঘাটু গানও অতিক্রম করতে পারেনি। তাই পরবর্তী ঘাটুগানে দেখতে পাই সমসাময়িক ঘটনাও স্থান পেয়েছে: দেখরে ইংরাজ লোকে কি কল কৈরাছে।/সাস্-সাগর পাড়ি দিয়া রাজ্য পাত্যাছে জঙ্গল কাইট্যা সড়ক দিছে/সেই সড়কে তার বসাইছে/দিনের খবর ঘড়িত্ আইনাছে ॥৩২
ঘাটু গানে সাধারণত দশ থেকে তেরো বৎসরের বালকদের অংশগ্রহণ করানো হতো। মূল গায়েন এবং দোহার ভূমিসমতল কোনো মঞ্চে অর্ধবৃত্তাকারে উপবেশন করে এই গান পরিবেশন করতেন। বর্তমানে এর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, এই সঙ্গীত এখন আর মঞ্চ নির্মাণ করে বা সাজিয়ে উপস্থাপিত হয়না। এমনকি নির্দিষ্ট কোনো স্থানেও তা পরিবেশিত হতে দেখা যায় না। বরং নগর কীর্তনের মতোই যে কোনো উৎসব উপলক্ষে (যেমন: হোলি, ঝুলন, ইত্যাদি) বাড়ি বাড়ি পরিভ্রমণ পূর্বক গৃহের যে কোনো প্রশস্ত আঙিনায় (এমনকি ঘাসের উপরও) অভিনেতাগণ নাট্যটি পরিবেশন করেন।
এতদ্ব্যতীত পূর্বে এই লোকনাট্যে বালকরাই রাধা ও কৃষ্ণ উভয় সাজে সজ্জিত হতো; অথচ বর্তমানে বালিকারা এই সাজে সজ্জিত হয়। অর্থাৎ দু’জন বালিকার একজন কৃষ্ণ ও আর অন্যজন রাধার সাজে সজ্জিত হয়ে এই লোকনাট্যে অভিনয় করে। মান মাথুরাদি পালাক্রমে বিভক্ত কৃষ্ণলীলাত্মক ঘাটু গানে বর্তমানে গীতিকবিতাই অভিনীত হয় বেশি। অর্থাৎ কাহিনী ভিত্তিক একটি বা দু’টি গীতিকবিতা এক একটি বাসায় অভিনয় করে অর্থ বা চাল/ডাল সংগ্রহ করা হয়।
তবে অভিনেতাগণ যাত্রার ঢং-এ পোশাক পরিধান করে এবং বাদক ও দোহারগণ যন্ত্র হিসেবে কঙ্গো, মন্দিরা, জিপসি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। একদা অশিক্ষিত ও নিম্নবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘ঘাটু’ ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। নিম্নবিত্ত অশিক্ষিত অভিভাবকগণ তাদের অপেক্ষাকৃত সুশ্রী বালকপুত্রকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত অভিনয় করার জন্য ঘাটু দলের নিকট বিক্রি করে দিতেন।
দীর্ঘ কেশ বিশিষ্ট এসব বালকদের রাধার চরিত্রে অভিনয় করানো হতো। বহুল জনপ্রিয়তার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষ বিদ্যাশিক্ষার পরিবর্তে তার বালকপুত্রকে ঘাটু দলে অন্তর্ভুক্ত করানোকেই উত্তম বলে বিবেচনা করতেন। উল্লেখ্য, অর্থ উপার্জনই এক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয ছিল। তবে রাধা ও কৃষ্ণ সাজে সজ্জিত হলেও এই লোকনাট্যে আধ্যাত্মিক ভাবের বিন্দুমাত্র স্পর্শও অনুভূত হতোনা।
অধিক অর্থ উপার্জনের আশায় কেউ কেউ বরং সাধারণ শালীনতাকেও বিসর্জন দিতেন। আশুতোষ ভট্টাচার্যের ভাষায়- ‘…এই রাধা বৃন্দাবনচারী নহেন, বাংলার ধূলি মলিন সন্তান।৩৩ ‘এ অনুষ্ঠানের গানগুলি অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও উপভোগ্য। বিশেষ করে কিষাণ কিশোরদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে এই গান গুলি তাদের খুব অন্তরঙ্গ ও মর্মস্পর্শী। এইগুলি যেমন রসোত্তীর্ণ তেমনি লোকসঙ্গীতের মর্মস্পর্শী আবেদন সৃষ্টিতে সার্থক। ‘৩৪
খ) গৌরলীলা :
কৃষ্ণলীলায় গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে গৌরকীর্তন গাওয়া হলেও চৈতন্য বিষয়ক মূল লোকনাট্য হলো চৈতন্যলীলা। একে গৌরলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, চৈতন্যলীলা বা লীলাকীর্তন বলা হয়ে থাকে। সাধারণত চৈতন্যের জীবনের নানা ঘটনা এতে উপস্থাপিত হয়, যেমন: জন্ম, বিয়ে, সংসার ত্যাগকে কেন্দ্র করে গৃহত্যাগী নিমাই, সামাজিক কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নিমাই সন্ন্যাস, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিরোধকে কেন্দ্র করে কাজীর বিচার ইত্যাদি। এসব লোকনাট্যের নাম ভিন্ন হলেও পরিবেশনরীতি একই ধরনের। তবে কোনো কোনোটিতে সঙ্গীত এবং কোনো কোনোটিতে কাহিনীর বিস্তৃতি থাকে অধিক।
কাহিনী অবশ্য হারমোনিয়মের কড ব্যবহার করে সুর ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের একেবারে গোড়াতে বৈদিক সুরে সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করা হয়। এসময় উপস্থিত মহিলাগণ উলুধ্বনি দেন এবং পুরুষগণ দু’হাত মাথার উপরে তুলে গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দকে স্মরণ করেন।
কীর্তনীয়া এরপর গুরুবন্দনা সম্বলিত একটি সঙ্গীত দোহার সহযোগে উপহার দেন। সঙ্গীতটি সচরাচর রাধারমণ সঙ্গীত হলেও অন্য কোনো কবি কর্তৃক রচিত গানও পরিবেশন করা যায়। এমনকি পালাকার নিজের লেখা গানও অনেক সময় এক্ষেত্রে উপস্থাপন করেন। তবে সঙ্গীতটি অবশ্যই রাধা-কৃষ্ণ কেন্দ্রিক হতে হবে। সঙ্গীত পরিবেশনের পর তিনি বলে ওঠেন-
আমার প্রণাম লহ গৌর হরি/তব নামে মেতে উঠুক বিশ্বের নরনারী । …
খোল, মন্দিরা, হারমোনিয়ম এ সময় বাজতে থাকে। দোহারগণ তাদের কর্তব্য শেষ করলে কীর্তনীয়া আর একটি চরণ উপস্থাপন করেন। এভাবে ৮/১০ মিনিট চলার পর সঙ্গীতটির পরিবেশনা শেষ হয় এবং কীর্তনীয়া গদ্যে কিন্তু সুর ও বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শ্রীচৈতন্যের ধরাধামে আগমনের কারণ ব্যাখ্যা করেন।
অতঃপর পৃথিবীতে জীবের দুর্গতি প্রত্যক্ষ করে চৈতন্যের মনের কী অবস্থা হয়েছিল তা বর্ণনা করেন সঙ্গীতের সুরে সুরে- একে প্রেমে মাতোয়ারা/চোখে তাই বহে ধারা/কেঁদে গৌর হয়েছে সারা । এভাবে কিছুক্ষণ দোহার কীর্তনীয়ার যুগল বন্দীর পর আবারো গদ্যে ব্যাখ্যা- জাতি, বর্ণ, ধর্ম ভেদে আক্রান্ত বাংলাকে শান্তির প্রেমের রসে সিক্ত করতে চৈতন্য শুরু করলেন কীর্তন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য প্রেমহীন জীবকে প্রেমময় করে তোলা। কীর্তনের মাধ্যমেই তিনি এই অসাধ্য সাধনে আত্ম নিয়োগ করলেন। তাঁর নামকীর্তন শ্রবণ ও প্রত্যক্ষ করে অবশ্য ভক্তরাও হলেন আনন্দিত। তারা বলরেন- ভালো রঙ্গে নাচে মোর শচীর দুলাল/ভালো রঙ্গে নাচে নিতাই দয়াল।
বিশাল হৃদয়ে দোলে বনফুল হার/পদ সঙ্গে ঝংকারে নূপুর টংকার ॥ … তারপর আবারো গদ্যে ব্যাখ্যা- তিনি উপলব্ধি করলেন, কথা বলে কোনো লাভ হবে না, উপদেশ দিয়ে কোনো উপকার হবে না। তাই তিনি নাচলেন, গাইলেন। নেচে গেয়ে প্রচার করলেন সাম্যের বাণী। এসময় আসরে পুনরায় উলুধ্বনি ওঠে এবং দু’মিনিট/চার মিনিট পর পর চলতে থাকে গদ্য পদ্যের যুগলবন্দি। এই লোকনাট্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে জাতিভেদ বা বর্ণবৈষম্য।
শ্রীচৈতন্য যে ব্রাহ্মণ হয়েও উঁচু-নিচু ভেদ জ্ঞান করতেন না এবং এটা যে কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়, এটাই এ লোকনাট্যে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায় সকল কীর্তনীয়াই বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় বক্তব্য ও পালা উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু সুর ও উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে তা পরিগ্রহ করে আঞ্চলিক রূপ।
সিলেটের লীলাকীর্তন ও গোষ্ঠগান পদাবলী সুরে পরিবেশিত হয় বলে কীর্তনীয়ারা উল্লেখ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা পদাবলীর প্রভাবপুষ্ট বাওলা সুর। উল্লেখ, সিলেটের বাওলা সুর সামা, পদাবলী, বাউল ও মুর্শিদী সুরের মিশ্রণজাত পৃথক একটি সুর যা কেবল সিলেট অঞ্চলেই পরিলক্ষিত হয়। মনুশাই (মনোহরশাহী থেকে উদ্ভূত) নামক অন্য একটি লোকসুরও অবশ্য এই সঙ্গীতে পরিবেশিত হয়; তবে সুরটি মূলত দ্বিপ্রহরে পরিবেশিত হয় বিধায় মধ্যহ্ন গোষ্ঠে এর প্রয়োগ বেশি।
কীর্তনীয়া এবং দোহার/বাদকগণের পোশাক যথারীতি ধূতি-পাঞ্জাবি। তাদের গলায় থাকে সুদৃশ্য গাঁদা ফুলের মালা। এতদ্ব্যতীত অনুষ্ঠানটি কোনো আখড়ার নাটমন্দিরে ভূমি সমতল মেঝেতে উপস্থাপন করা হয় বিধায় চতুর্পাশ্বে উপবিষ্ট থাকেন দর্শক-শ্রোতামণ্ডলী এবং মধ্যখানে সঙ্গীত-বাদ্য দল। কীর্তনীয়া প্রথমে উপবিষ্ট অবস্থায় আসর শুরু করলেও বন্দনা অংশ থেকে শেষ অব্দি দাঁড়িয়েই তা উপস্থাপন করেন।
কৃষ্ণ ও গৌরলীলা বিষয়ক লোকনাট্যের প্রত্যেকটিই একাধিক তালে পরিবেশিত হয়। দেখা গেছে দাদরা তালে শুরু হওয়া গানটি হঠাৎ করে খেমটা তালে পরিবর্তিত হচ্ছে। আবার দু/তিন মিনিট এভাবে পরিবেশিত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার কাহারবা তালে জমে ওঠে। এতে আসর যেমন একঘেয়েমিতা থেকে মুক্তি পায়, তেমনি ভক্ত-শ্রোতাদের মনে সূচিত হয় বৈচিত্র্যপূর্ণ আলোড়ন।৩৫
উল্লিখিত হয়েছে, পূর্ববঙ্গীয় কীর্তনের ধারা পশ্চিমবঙ্গীয় ধারা থেকে যথেষ্ট স্বতন্ত্র। লক্ষ করা গেছে পশ্চিমবঙ্গীয় কীর্তনে বিশেষ বিধি হলো মহাজনি পদ ধরে গান গাওয়া। কিন্তু পূর্ববঙ্গে এধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের শিল্পী কর্তৃক পরিবেশিত গানে মহাজনি পদের ব্যবহার নেই বললেই চলে। যে সব পদ তাঁরা মহাজনী পদ বলে উল্লেখ করেন, তারও অনেক গুলোই স্থানীয় শিল্পী কর্তৃক রচিত। অন্যন্য পদ কীর্তনীয়া নিজেই তৈরি করেন।
তাল ও রাগের ক্ষেত্রে অনেকসময় হিন্দুস্থানী ধারার অনুসরণ লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে সময়ভেদে ভৈরবী, আশাবরী, ইমন, মালকোষ, চন্দ্রকোষ ইত্যাদি রাগিণী এবং তাল হিসেবে ত্রিতাল, ঝাঁপতাল, তেওড়া, একতাল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঁচালী, মঙ্গলকাব্য, যাত্রা, বাওলা, মনুশাই ইত্যাদি প্রভাবিত সুর এবং কাহারবা, দাদরা, খেমটা প্রভৃতি চটুল স্তরের তাল, লক্ষ করা যায়।
ভাষাগত প্রকরণের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গীয় রীতিতে ব্রজবুলি বা মৈথিলি পদের প্রভাব বেশি। ৩৬ কিন্তু পূর্ববঙ্গীয় কীর্তনের প্রায় সকল পদই বাংলা প্রভাবিত। স্থানীয় বাংলাও এক্ষেত্রে কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়। তাই নামে কীর্তন হলেও এগুলো মূলত লোকগীতিরই ভিন্নতর ধারা হিসেব বিবেচিত। ৩৭ সিলেট সহ বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে বৈষ্ণব সহজিয়াদের পুনরুত্থান লক্ষ্য করার মতো। তবে এদের অধিকাংশই আবার লোকনাথ এবং শক্তি দেবীর প্রতিও অনুরক্ত।
সিলেট শহরের লামাবাজারস্থ শ্যামসুন্দরের আখড়া ও দাড়িয়াপাড়াস্থ মদন-গোপালের আখড়ার অতি সন্নিকটে এবং চূড়ার পাড়াস্থ বৈষ্ণব অধ্যুষিত অঞ্চলে কালী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা আমাদের এই তথ্যই প্রদান করে। একইসঙ্গে একই ভক্ত কর্তৃক কালী, দুর্গা, লোকনাথ ও কৃষ্ণের আরাধনার বিষয়টি এতদঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মত ও পথের প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধার বিষয়টিই আমাদের সম্মুখে তুলে ধরে।

সংক্ষেপে বৈষ্ণব:
১. বিষ্ণু/কৃষ্ণের উপাসক। এখনো বাংলাদেশে কিছু সংখ্যক বৈষ্ণব আছেন যারা কেবল কৃষ্ণের উপাসনা করেন এবং অন্যদেরও কেবল কৃষ্ণের আরাধনা করার পরামর্শ প্রদান করেন। তবে বাংলায় বর্তমানে বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব প্রভৃতি পরিচয় অন্তর্হিত হয়েছে এবং সকলেই একে অন্যের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে বিভিন্ন আচার- অনুষ্ঠানাদি পালন করছেন।
২. গৌড়ীয়বৈষ্ণবগণ নিজেদের রাধারূপী জীবাত্মা কল্পনা করে পরমাত্মারূপী কৃষ্ণের আরাধনা করতেন।
৩. অনেকেই ছিলেন সংসার ত্যাগী এবং নিরামিষ ভোজী। এখনো অনেকে সপ্তাহে এক থেকে দুদিন নিরামিষ ভোজন করেন।
8. এঁরাও স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে গুরুর শরণাপন্ন হন।
৫. তাঁরা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহকে পূজা করেন; তাই তাদের নির্দিষ্ট উপাসনালয় বা আখড়া বর্তমান।
৬. সঙ্গীত তাঁদেরও আরাধনার অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
আরও পড়ূনঃ
