আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় মিয়া সলিম উল্লাহ চৌধুরী। মিয়া সলিম উল্লাহ্ চৌধুরী ছিলেন নলডাঙ্গাধীন একজন তালুকদার । সবাই তাকে জামিদার বলেই জানতো। চৌধুরী সাহেবের সাথে কবির অত্যন্ত সখ্যতা ছিল । চারণ কবি পাগলা কানাই সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে যে কয় জন ব্যক্তির নাম করতে হয় তাদের মধ্যে জমিদার সাহেব অন্যতম। তিনি ছিলেন বিপদের দিনে কবির অকৃত্রিম বন্ধু ।
চৌধুরী সাহেবের পূর্বতন বসত ছিল পদ্মাবিলা-ধূলাদি গ্রামে। পিতা বুধাই বিশ্বাস এক জন খ্যতনামা ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। যৌবনে মিয়া সাহেব কোলকাতা এক বাইজীর প্রেমে পড়েন। নিম্ন বংশের এই গোয়ালা কন্যাকে তিনি বিয়ে করেন। কিন্তু পিতার ভয়ে প্রথমে কিছুই প্রকাশ করতে সাহসী হননি। কোলকাতাতেই এই স্ত্রী আশরাফুন্নেছাকে রেখে দেখাশোনা করতে থাকেন ।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি আশরাফুন্নেছাকে বাড়িতে আনার বন্দোবস্ত করেন । কিন্তু প্রথমা স্ত্রী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের ঘোর আপত্তির মুখে তিনি অন্যত্র বসত বাটি করতে বাধ্য হন । এবং মুরারীদহ গ্রামে নবগঙ্গা নদীর কুলে তিনি স্থান বেছে নেন ।
এই স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে অত্র অঞ্চলে একটা প্রবাদ আছে যে বাড়িতে স্থান না পেয়ে তিনি পুনরায় কোলকাতাতে ফিরে যাচ্ছিলেন। বজরা ধীর গতিতে চলছিল । বজরার উপর বসে তিনি তামাক সেবন ও নদী-তীরের শোভা উপভোগ করছিলেন।
সন্ধ্যার কিছু আগ মুহূর্ত। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, বর্তমান যে স্থানে বসত বাটি ঠিক সেই স্থানে নদী তীরে ঝোপ-জংগল আন্দোলিত হচ্ছে। বজরা নোঙ্গর করে সে স্থান পরিদর্শনের জন্য মাঝিদের আদেশ দেন। মাঝিরা ঘটনাস্থল দেখে অবাক। সে এক অবাক কাণ্ডই বটে। প্রকাণ্ড একটা ভেক একটা জাতি সাপকে গিলে খাচ্ছে। এ দৃশ্য অবলোকন করে জমিদার সাহেব প্রকৃতির আর্শীবাদ ও মঙ্গল চিন্তা করে সেখানেই ছাউনি ফেলেন । এবং ঐ স্থানটা ক্রয় করে বাড়ি তৈরি শুরু করেন।
নদী গর্ভ থেকে এ বাড়ি তৈয়ার করতে নয় বছর সময় লেগেছিল । কাখত আছে। বহু, দেশি-বিদেশি মিস্ত্রীদের কাজের শেষে গুনতিতে এক জন করে কম পড়তে এই অলৌকিক ঘটনার কারণ কেউ বুঝতে পারে নি চৌধুরী সাহেব বাড়িখানাকে অত্যন্ত সুদৃশ্য ও মনোরম রাজবাড়ির মতো করে প্রস্তুত করেন ।
এখান থেকেই তিনি জমিদারীর কাজ-কর্ম দেখাশোনা করতেন। সব সময় লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকার ব্যবস্থাও করেন তিনি। এখনও নবগঙ্গা বক্ষে এই বাড়ি জরা-জীর্ণ অবস্থায় অতুল ঐশ্বর্য, স্থাপত্য শিল্প বোধ ও উন্নত মানের রুচীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আশরাফুন্নেছাকে নিয়ে সারা জীবনই তিনি এখানে কাটান । এ পক্ষে দুদু চৌধুরী নামে একটা পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন । বাড়িটার সিংহ দরজায় উৎকীর্ণ ফলক এখন জরাজীর্ণ। তাতে খোদাই করা আছে-
“শ্রী শ্রী রাম মুরোদ্দা গ্রাম ধাম : বিবি আশরাফুন্নেছা
নামঃ কি কহিব হুরের বাখান | ইন্দ্রর অমরা পুরী :
নবগঙ্গা উত্তর ধার : ৭৫০০০ টাকায় করিলেন নির্মাণ ॥
এদেশে কাহারও সাধ্য : বাধিয়া নদীর অঙ্গ : জল মধ্যে
কমল সমান : ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান-”
(ফলকে যে ভাবে আছে, ঠিক সে ভাবেই তুলে দেওয়া হলো।)
কবির পদাবলীতে আমরা চৌধুরী সাহেবের সুন্দর একটা আলেখ্য পাই-
“আরে ও মিয়ার সোনার মুরোদ্দা চান্দের বাজার,
আমরা চার বয়াতি গাচ্ছি জারী এই মিয়ার দরগায় ।
তাই পাগলা কানাই বলে-ও আল্লাহ্ বলোরে-
আরে ও মিয়ার জয় জয় ॥ আরে ও মিয়ার খোস নাম বলি,
আল্লাহ্র ওলী । বাহা মজার দালান দিয়াছেন নবগঙ্গার কুলি ।
আরও রং দেখা যায় বর্ষা আ’লি ॥ আরে ও মিয়ার দালান জলে ভাসে,
এওতো বড় আজব কল । আহারে জমিদারের কপাল-
মিয়ার মনে হইছিল খিয়াল ।
কত বাজে লোক খা’য়ে গেলো, গরীব আর কাঙ্গাল । ও নেকির ভারা কোন দিন যায় নারে তল ॥”
উরু কবিতায় আমরা প্রমাণ পাই যে, চৌধুরী সাহেব অত্যন্ত ধার্মিক ও দানশীল লোক ছিলেন। প্রতিদিন লোকের পাত পড়তো তার দরবারে। তাছাড়া আষাঢ় মাসের ৭ তারিখে (অমাবতীর দিনে) ৭ দিন ধরে বিভিন্ন প্রকার জলসার আয়োজন করা হতো। মিয়া এ জলসাতে ৩০/৪০ মন চাল ও ১০/১৫ মন ডাল। শ্রোতাবৃন্দের জন্য বরাদ্ধ করতেন। হাজার হাজার লোক এই জলসাতে হাজির হতো ।
এই সব জলসাতে চারণ কবি পাগলা কানাই প্রধান বয়াতি হিসাবে থাকতেন । তার পাগল করা সুরে দলে দলে মানুষ ছুটে আসতো । গ্রাম বাংলার সহজ-সরল হৃদয়ের অভিব্যক্তি কোন মানুষই উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ, অতি অল্প কথায় হৃদয়ের কথা প্রকাশ করা ও অভিনব সুরে মানব মনে মায়া জাল সৃষ্টি করা পাগলা কানাইয়ের ছিল অত্যন্ত সহজ। সত্য কথা বলতে কি, পাগলা কানাইয়ের সুরের জ্যোতিতে সমগ্র বাংলাদেশ সমুজ্জল হয়ে উঠেছিল।
এক বার মিয়ার বাড়িতে পাল্লা করার সময় আশরাফুন্নেছার অনুরোধে কৃষ্ণ-বিন্দে বিষয়ক গান শুরু হয় । এক পক্ষ কবি ও অন্য পক্ষ দেশের বড় বড় বয়াতি কবিগণ । আসর বন্দনা করে এক খানা দৈন্য গীতি গাইবার পর কবি নিম্নের প্রশ্ন গীতি গাইলেন ।
“ও রাধার পুষ্পু ফোটে শুনি বটে, মুর্শিদ আমার বলেছে ।
শ্রী কৃষ্ণের পদ্ম ফোটে কোন দিবসে ” । (৪২ নং পদ)
প্রশ্ন শুনে প্রতিপক্ষ বিশেষ করে তরিবুল্লা, আরজান, রাসু মানিক, নৈমদ্দিন প্রমুখ বয়াতিগণ ‘থ’ হয়ে গেলেন। তরিবুল্লা তর্জন-গর্জন কর উঠে বললেন, “পাগলা কানাই মন গড়া গান করে আমাদের ঠকাতে চায়। শাস্ত্ৰ বিহীন গান আমরা মানি না। যার প্রশ্ন সেই উত্তর দিক।
গান গাইলেই হলো? এই বার দেখবো কানাইয়ের কেরামতি”। মিয়া সলিমুল্লাহ চৌধুরী জনতার চঞ্চলতাকে খেয়াল করে পাগলা কানাইকে উত্তর গান করার পরামর্শ দিলেন। কবি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। হর্ষোৎফুল্ল জনতা আল্লাহ্ আল্লাহ্ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানালো । কোমল ও গম্ভীর স্বরে কবি ঘোষণা দিলেন
গায়েন শুনে লোকে ভাবে মনে মনে ।
মিথ্যা কথা বলছে কানাই ঠকাবার জন্যে।
আমি শাস্ত্র ছাড়া ধুঁয়া বাঁধি নাই কভু দিনে ।
বলি সবার বিদ্যমানে। যদি না পার তো শুনে নিও-
পাগলা কানাই করে দিবে মানে।
বিপক্ষ দলে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। কারণ, তারা জানতেন যে পাগলা কানাই কোন বাজে কথা বলেন না। কবি সু-মধুর সুরে তার গানের জওয়াব দেবার জন্য। 1 প্রস্তুত হলেন। উজোল খুখুরীতে থাবা দিয়ে শুরু করার সংকেত সুর বাজালেন। তিনি গাইলেন-
“ও রাধার পুষ্প ফোটে শুনি বটে, অমাবশ্যার যোগ মতন।
কৃষ্ণের পদ্ম ফোটে কোন দিবসে-ও সে সোমের ঘরে যখন” (৪১২ পদ)
গান করার পর শ্রোতাবৃন্দ পাগলা কানাইয়ের জয়গানে পঞ্চ মুখ হয়ে উঠলো। সংগে একথাও প্রমাণিত হয়ে গেল যে এতদঞ্চলে পাগলা কানাইয়ের সমকক্ষ বয়াতি কবি আর নেই। চৌধুরী পত্নী আশরাফুন্নেছা কর্তৃক তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুস্কারে ভূষিত হলেন ।
Table of Contents
মিয়া সলিম উল্লাহ চৌধুরী

নলডাঙ্গা রাজ বাড়িতে কবি
নলডাঙ্গা রাজবাড়ির নাম আমরা অনেক আগেই উল্লেখ করেছি। কবি এই রাজ বাড়িতে বহু বার পাল্লায় গান করেছেন । প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতে ও কবির পদে এ কথার প্রমাণও আছে । নলডাঙ্গার রাজা ইন্দু ভূষণ দেব রায় (১৮৩৪-৭০) ও প্রমথ ভূষণ দেব রায়ের (১৮৭০-১৯৪৭) সাথে কবি পাগলা কানাইয়ের যথেষ্ঠ হৃদ্যতা ছিল।
কথিত আছে রাজা প্রমথ ভূষণ দেবরায় কবিকে ২৫ বিঘা জমি লাখেরাজ দিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা শালও উপহার দিয়েছিলেন । নলডাঙ্গা রাজা কর্তৃক প্রদেয় একটা শাল এখনও কবি অধঃস্তণ জনাব আবু রায়হানের নিকট গচ্ছিত আছে ।
১৮৩৪ সাল। রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায়ের রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে বিরাট এক গানের জলসার আয়োজন করা হয় । কবির বয়স তখন ২৬/২৭ মাত্র। উদীয়মান গায়ক হিসাবে ধুয়াজারী গানে পরিচিতি লাভ করেছেন। পাগলা কানাই প্রতিপক্ষ হিসাবে এই প্রথম রাজ দরবারে হাজির হন । বিপক্ষকে হারিয়ে কবি রাজার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সমবয়সী রাজা কবি-গানে ছিলেন পাগল। ফলে, অল্প দিনের মধ্যেই উভয়ের মধ্যে গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে।
সনাতনী ধর্মীয় অঙ্গ হিসাবে হিন্দু পরিবারে প্রায়ই গান-বাজনার আয়োজন হতো । তাছাড়া, ধনাঢ্য পরিবারে চুরি-ডাকাতির ভয়ে বিভিন্ন জলসার মাধ্যমে লোক সমাগম করে রাখা হতো।
গানের আসরে পাগলা কানাই উপস্থিত থাকলে ইন্দু ভূষণ ও প্রমথ ভূষণ বাবু প্রায়ই আসরে এসে বসতেন। মাদুর পেতে চোখ বুঁজে বুঁদ হয়ে বসে গান শোনতেন। রাজা সাহেব কবিকে ‘নন্দের কানাই’ বলে আখ্যা দেন। এমনকি তিনি কবিকে এতো ভালো বাসতেন যে, নিজের হুকা পর্যন্ত ব্যবহার করতে দিতেন। কিন্তু কবি রাজাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন, ধুমপান না করে রেখে দিতেন।
একবার রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় বাহাদুর ১৮৫৩ সালে ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাত থেকে রাজ্য ভার গ্রহণ উপলক্ষে এক গানের অনুষ্ঠানে প্রথম পুরস্কার হিসাবে কবিকে শাল উপহার দিতে চান। কবির শালের কথা শুনে শ্রোতা মণ্ডলীর কাছে বলেছিলেন, “শাল আর কত নেবো। ঘেন্না করে আমার মা শালে ধান নেড়ে দেন” । একথা রাজার কানে পৌঁছলে তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। সংগে সংগে বেড়বাড়ি লোক পাঠান তদন্তের জন্য। কবি সামনে মসিবৎ দেখে দলের এর জনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন।
রাজ ভৃত্যদ্বয় কবি গৃহে এসে দেখে সে এর অবাক কাণ্ড । কবির বৃদ্ধা মাতা ও বোন ৮/১০ খানা শাল বিছিয়ে ধান শুকাচ্ছেন । রাজা দূত মুখে ঘটনার সত্যতায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার পালের সেরা ঘোড়া উপহার দেন। ঘোড়া পুরষ্কার পেয়ে কবিও খুব খুশি হন। অভি বিনয়ের সাথে তিনি বললে, “ রাজা বাহাদুর। আপনি দয়া করে আমার মতো একজন নগন্য গায়ককে ঘোড়া পুরস্কার দেয়াই আমি খুব গৌরব বোধ করছি।
কিন্তু আমি যে ঘোড়ায় চড়তে জানি না। (এখানে বর্ণনাকারী হেসে উঠে বলেন, পাগলা কানাই ঘোড়ায় চড়তে পারতেন। উনি একটা কৌশল খাটান। তার নিজেরও ঘোড়া ছিল।) চ’ড়ে না গেলে আপনার অসম্মান করা হবে। আমাকে সাত দিন সময় দিন। সাত দিন পর চড়া শিখে এসে পুরস্কার নিয়ে যাবো । রাজা মহাশয় কবির বিনয় বচনে অত্যন্ত খুশী হয়ে বললেন, “তাতে কি হয়েছে কবি সাহেব। আমার ‘নন্দের কানাই’ ঘোড়া পুরস্কার পেয়ে হেটে যাবে”।
তিনি তখন দু’জন ভৃত্যকে আদেশ করলেন যে, পাগলা কানাই ঘোড়ায় যাবে এবং একজন ঘোড়ার লাগাম ধরে যাবে ও অপর জন কবির হাত ধরে পাশে পাশে যাবে । রাজা তার ‘নন্দের কানাই’কে এই ভাবেই বেড়বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।
যতদূর দৃষ্টি যায় রাজা তার ‘নন্দের কানাই য়ের গমন পথে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন । রাজ বাড়িতে চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের এ ধরনের সম্মান ছিলো । নলডাঙ্গা রাজবাড়িতে কবি পাগলা কানাই শুধু যাতায়াত করতেন তা নয়, রাজাও কার্যাপলক্ষে এ অঞ্চলে আসলে কবির বাড়ি বেড়িয়ে যেতেন বলে শোনা যায়। রাজা মুকুট রায় কর্তৃক খোদিত ঢোল সমুদ্র দীঘির পাড় গুলো কালের ব্যবধানে গভীর জংগলে পরিণত হয়ে পড়ে।
এই গভীর জংগলে আমরাও দেখেছি বাঘের গর্জন ও বন্য শুকরের আনাগোনা। এই জংগলকে কেন্দ্র করেই মাঝে-মধ্যে, আশে-পাশের গ্রামগুলিতে বাঘ-শুকরের হানা পড়তো। খবর পেয়ে নলডাঙ্গার রাজা নিজে বা তার প্রতিনিধি পাঠাতেন বাঘ-শুকর মারতে । একবার বাঘ শিকারে এসে রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় বাহাদুর কবি গৃহে আগমন করেন । কবি রাজার আগমন হবে ভাবেন নি কখনও । তিনি তাড়াতাড়ি বসবার ব্যবস্থা করলেন ।
এক থানা চৌকির উপর বিছানা পেড়ে দিলেন বসবার জন্য। রাজা বললেন, “কৰি ভাই, তোমার খেজুর পাতার মাদুরে বসেই আজ আমি ধন্য হলাম। রাজার সাথে কিছু অমাত্য বর্গ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিও ছিলেন। কবি তাড়াতাড়ি খাবার আয়োজনের ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু রাজা মশায় বাধা দিয়ে। বললেন, “যে মাতা সংসারের অনিত্যতা বুঝতে পেরে শালে ধান শুকায়, আমি সেই মাতার হাতে গুড়, মুড়ি আর নাড় খেয়ে ধন্য হবো |
রাজা প্রমথ ভূষণ দেবরায়ের শাসনকালে ঢোল সমুদ্র দীঘির পারে বাঘের আনাগোনা হয় । প্রতিদিনই প্রায় দু-একটা করে গরু ছাগল ধরে নিয়ে যেত। দীঘির পাশে দিনেও ঘুরে বেড়াত । লোকজন ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। কখন কাকে ধরে নিয়ে যায় । কবি পাগলা কানাই খবর পেয়ে বিদেশ থেকে বাড়ি আসলেন গান বন্ধ করে। তিনি রাজার নিকট অনুরোধ করলেন বাঘ মারাবার জন্য । রাজাও বাঘ মারবার প্রস্তুতি নিয়ে পর দিনই চলে আসলেন ।
সংগে বন্দুক রাইফেল এবং ১৬টা হাতী। অভিযান শুরু হলো। কিন্তু বাঘের কোন হদিস পাওয়া গেলনা। সকালেও বাঘ দেখা গেছে। রাজা মশার চিন্তায় পড়লেন । কি করে? শেষে কোন কুল কিনারা না পেয়ে রাজা তাঁর ‘প্রিয় হাতী পাগলা’ কে ডাকলেন-“কিরে পাগলা, তুই থাকতে আমি কি বেয়াকুব হয়ে যাব”? রাজার কথায় পাগলা ক্ষেপে উঠল। গর্জন করে সাথিদের সংগে নিয়ে সমস্ত পুকুর পাড় চষে দেখতে লাগলো। শেষে এক নালার মধ্যে বাঘ বাঘিনী ও দুটা বাচ্চা ধরা পড়লো ।
পাগলা বড় বাঘটাকে মাথার উপর উঁচু করে রাজার সামনে এনে হাজির । শুড়ের মাথায় বাঘ ছটফট করছে । রাজা বললেন, – “ওরে মেরে ফেল, মেরে ফেল” । এমনি ধরনের কতো অজানা কাহিনী কবির জীবনের সাথে মিশে আছে তার ইয়ত্তা নেই ।

প্রতিদ্বন্দ্বী ইদু বিশ্বাস
চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের ধুয়া-জারী তথা ধুয়া গানের জগতে তার শিষ্য বৃদের মধ্যে ইদ্রীস আলি বিশ্বাস ওরফে ইদু বিশ্বাস আর একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। বয়সে তিনি ওস্তাদ থেকে কিছু ছোট ছিলেন। ঘোড়ামারা গ্রামে তার জন্ম এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয় । ইদু বিশ্বাস বাংলা ও আরবি ভাষা কিছু জানতেন এবং শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন ।
ইদু বিশ্বাস এর বাল্যকাল সম্পর্কে জানা যায় না। পিতা মাতার পরিচয়ও মেলেনা । সম্ভবত তিনি কোন গরীব চাষি ঘরের সন্তান ছিলেন। প্রতিভাবলে তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেন । আমরা অনুসন্ধান করে জানতে পারি যে তিনি কবি পাগলা কানাই থেকে ৩/৪ বছরের ছোট ছিলেন। সে হিসেবে ১২১২/১৩ সালে জন্ম হয়। এবং ১৩০৩/০৪ সালে মৃত্যু বরণ করেন । ইদু বিশ্বাসের এক মাত্র কন্যা মোমেনা খাতুন। তারও এক মেয়ে জরিনা। আগ্নে মেছের বিশ্বাস বেশ ভাল কবিয়াল ছিলেন ।
আমার সংগ্রহে তার কয়েকটি গান আছে। ড. মযহারুল ইসলাম সাহেব মেছের বিশ্বাসের কয়েকটা গান পাগলা কানাই বলে উল্লেখ করেছেন । প্রথম জীবনে ইদু বিশ্বাস কবি পাগলা কানাইয়ের সংস্পর্শে এসে তার প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দেশে দেশে কবি পাগলা কানাইয়ের দলভুক্ত হয়ে দোহারী করে বেড়াতে থাকেন। এ ভাবে গান করে বেড়াতে বেড়াতে তার সুপ্ত প্রতিভা জাগরিত হয় ।
ধুয়া-জারী বয়াতি হিসাবে অনেকেরই নাম করতে হয়। যেমন নইমদ্দীন, নছরদ্দীন, তরীবুল্লাহ্, আরমান, বিনোদ, কোরেশ, পাগলা কোরেশ, জাহের (জহর), অছিম, এনাতুল্লাহ্, তিলক হোসেন, নেওয়াজ সাহ্, পিয়ার, ছমির, মেছের, মকলেস, মকছেদ মোল্লাহ, হাকিম চাঁদ, হেরাজ ভুল্লাহ, কোরবান, রোশন খা, কলিমদ্দিন, কাদের, তাহের মুন্সী, তাইজদ্দিন মোল্লাহ্, আবেদ, আরমান, ইয়াছিন, রাসু মানিক, শ্রীমতি হরমনি প্রভৃতি ।
কিন্তু কবির যে দুই জন প্রধান শিষ্য ধুয়া জগতে নিজেদের আসন দখল করে নিয়েছেন তারা হলেন ইদু বিশ্বাস ও সুলতান মোল্লাহ। তবে, এদের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় । তা হলো, ইদু বিশ্বাস হলো মূলতঃ কবি এবং সুলতানা মোল্লাহ ছিলেন মূলতঃ সাধক। অর্থাৎ কবিতা রচনা করতে যতটুকু সাধনার প্রয়োজন হয়েছে তাই করেছেন এবং মোল্লাজী সাধনা করতে গিয়ে যতটুকু কবিতা রচনার প্রয়োজন হয়েছে তাই রচনা করেছেন।
তাই দেখা যায়, ইদু বিশ্বাসের কবিতাগুলোর মধ্যে শব্দের পারিপাট্য, ছন্দ-মাধুর্য, বাক্য-সংযোজন অত্যন্ত সুন্দর রূপেই প্রকাশ পেয়েছে । তার কবিতাবলী একটু দীর্ঘ ও জটিল । অপর পক্ষে সুলতান মোল্লাহ্র কবিতা বা গানগুলি অপেক্ষাকৃত সহজ ও সরল । ইদু বিশ্বাস কবি পাগলা কানাইয়ের উপযুক্ত শিষ্য ছিলেন ।
পরবর্তীতে তিনি গুরু াদের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। তবে, ইদু বিশ্বাস কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখেন নি এক গানের আসর ছাড়া । বরং সারা জীবনই তিনি কবিকে ওস্তাদ/পীর হিসাবে সম্মান করে এসেছেন । তার পদেই এ কথার পরিচয় মেলে-
“চমৎকার এক কথা শুনলাম ভাই
বলো এখন কোথায় আমি যাই ।
কাতর দেলে ইদু বিশ্বাস কয় ।
ওস্তাদ আমার পাগলা কানাই-
তিনার কাছে শুনতে পায়” । (পরিশিষ্ট ২১ নং গান)।
“আমাদের নিতে চাও, সাঁইজীর পত্র দেখাও, ঠিক কথা কও ।
আমার হবে মজা দেখবা ভালো-
ধর্ম রাজার হাত চিঠি খান দাও” । (পরিশিষ্ট ৫ নং গান)
ইদু বিশ্বাস কিভাবে ওস্তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হলো, সে সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা শোনা যায়। অধ্যাপক খোন্দকার মকবুল হোসেন সাহেব কবি পাগলা কানাইয়ের মানস পরিক্রমা বইয়ের ৩৫ পৃষ্ঠায় ইদু বিশ্বাস শিষ্যত্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বী হবার সম্পর্কে যে গল্পের অবতারণা করেছেন তা যুক্তিপূর্ণ নয়। আমরা প্রকৃত ঘটনাটা এখানে উল্লেখ করলাম। ইন্দু ভূষণ দেবরায় ১৮৩৪ সালে সিংহাসনে বসেন এবং ৫৩ সালে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের হাত থেকে নিজ হাতে নেন এবং ১৮৭০ সালে মারা যান।
একবার নলডাঙ্গা রাজ বাড়িতে এক পাল্লা গানের আসরে পাগলা কানাইয়ের সাথে কেউ আর টিকে থাকতে পারলো না। ফলে, গান ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হলো । রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় কবিকে বললেন, “কিহে নন্দের কানাই, তোমার সাথে কি কেউ নেই গান করাবার মতো”? রাজা মশায়ের এই কথাতে নন্দের কানাই শিষ্য ইদু বিশ্বাসকে অনুমতি দিলেন বিপক্ষ হয়ে পাল্লা করার জন্য । ঘটনাটা ১৮৫৩ সালের । কবি তখন মাঝ বয়সী । ড. মযহারুল ইসলাম সাহেবের ‘কবি পাগলা কানাই’ গ্রন্থে ১৯৯ নং পদে, “কানাইর ভিজে গেল কটা দাঁড়ি” বলে কবি সে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ওস্তাদের বিপক্ষে খাড়া হতে হবে। এ কেমন কথা! আশ্চর্য ও ভয়ে তিনি সব কিছু হারিয়ে ফেললেন । তিনি কাপতে শুরু করলেন। কবি তার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন এবং পাশে দাড়িয়ে প্রথম আসরে গান গাওয়ালেন। ওস্তাদের দোয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে সারা জীবনই পাল্লা করে বেড়িয়েছেন । এ সম্পর্কে কবির গানে দেখতে পাই,-
“ছ্যাকড়ারা কয় ও ওস্তাদজী তোমার গাঁয়ে দেখি কি?
তখন পাগলা ইদু উঠে বলে আগুন পাব কার বাড়ি ।
ওর রং বলতেছে পাগলা কানাই-
তার রং দিতেছে ইদু ভাই” ।
এক বার রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় পত্র মারফৎ কবিকে ডেকে পাঠান। আশা, কবির নিকট জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা শুনবেন। পত্র পেয়ে সদলবলে রাজবাড়ি উপস্থিত হলেন। সংগে ছোট উজোল, শিষ্য ইদু বিশ্বাস, সুলতান মোল্লাহ, ছমির আলি, অমেদ আলি প্রমূখ ।
ঐ দিন আর গান হলো না। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে রাজা মহাশয় কবির সাথে আলোচনায় বসলেন। রাজা কবির জ্ঞানের গভীরতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হলেন। নাট মন্দির’-এ কবিকে বিশ্রাম করতে দেয়া হলো ।
পর দিন গান শুরু হলো। কবি শিষ্য ইদু বিশ্বাস কবির প্রতিপক্ষ। লোকে লোকারণ্য । প্রথমেই কেশবপুরের ছমির বয়াতি আসরে উঠলেন। কিন্তু লোকের ভীড় ও গুঞ্জন ধ্বনিতে ছমিরের গান আর শোনা গেল না। সবাই পাগলা কানাইয়ের গান শুনতে তাকে এক নজর দেখতে, হই-হল্লা শুরু করে দিল । শেষে ছমির নিম্নের পদটি গেয়ে বসে পড়লেন,
“কানাই কানাই করিস তোরা বাসায় আছেন সে ।
আমি নির্গুণের ছমির আইছি সভাতে”।
“কেহ করো না হুড়োহুড়ি,
গোল মাল করে যাইও না বাড়ি,””
“খনিক পরে দেখবি তোরা—
পাগলা কানাই আসছে সভাতে”।
ছমিরের গান শেষ হলে সেই চিরাচরিত হাসি মুখ নিয়ে চারণ কবি পাগলা কানাই আসরে এসে শ্রোতাবৃন্দকে সালাম জানিয়ে দাঁড়ালেন। সাথে আর সব শিষ্যবৃন্দ উপস্থিত। প্রতি পক্ষ ইদ বিশ্বাস। সভার লোক জন নিরব নিথর। পাল্লা চলতে লাগলো। কয়েক ঘন্টা পান্না চলার পরও ইদু বিশ্বাস কোন মতেই আর পেরে উঠলেন না। শেষে এই ঠ্যাশ গানটি গাইলেন-
“হ্যাদেরে ও গরা কানাই, বাড়ি তোর শাক সেজেনা
ওর আকাড়া চাল, তোওড়ার ডাল-
তোর কচুর শাকে নুন জোটে না ।
বিদেশে এসে তুই বসলি ফুল বিছানায়”।
(রাজা ইন্দু ভূষণ দেবরায় কবিকে সম্মান করে নাট মন্দিরে-৭ ফুল বিছানা পেতে দেওয়াতে ইদু বিশ্বাস এই ঠ্যাশ দেন। কবি আসরে উঠেই বললেন, ইদু বিশ্বাস। ভয় নেই । ঢেপের খই আর না’লির তরকারিই হবে। পাগলা কানাই করলেন-
“চুপ চুপ ভাই সকলরা গোল করবেন না-
কানাই যেমন ছাচের গোরা,
ডাইনে বামে দুজন তারা,
পুরুষ নিন্দা নাই”।” (১২২ নং পদ।)
একবার ইদু বিশ্বাস ওস্তাদকে পাল্লায় ঠকাবার জন্য একটা ফাকড়া গান তৈরি করে রাখেন । প্রশ্নটা হলো-একই মায়ের গর্ভে একই সংগে বহু সন্তানের জন্ম হয় । মায়ের গর্ভ থেকে তাদের মুণ্ডু দেখা যায় । সে মায়ের নাম কি?” আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধ পুরুষের সাথে কোন প্রকার চালাকি খাটে না। আসরে উঠেই কবি ঘোষণা করলেন যে-ভাই সব, ইদু বিশ্বাস যদি ইচ্ছা করে তবে আজ পাল্লা হবে পদ্ম ফুল নিয়ে।
ঘোষণা শোনার সাথে সাথে ইদু বিশ্বাসের মুখ মলিন হয়ে গেল । প্রকাশ থাকে যে উক্ত প্রশ্নের উত্তর পদ্ম ফুল” । এমনি ধরনের কত উপাখ্যান তাদের ঘিরে ছড়িয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই ।
প্রিয় শিষ্য সুলতান মোল্লাহ
চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের শিষ্যবৃন্দের মধ্যে ঘোড়ামারা নিবাসী ইদ্রিস আলি বিশ্বাস ওরফে ইদু বিশ্বাসের পরেই যার নাম করতে হয় তিনি আড়ুয়াভাঙ্গা নিবাসী সুলতান আলি মোল্লাহ । সুলতান ছিলেন উপযুক্ত ওস্তাদের উপযুক্ত শিষ্য। কবি তাকে মনের মত করে গড়ে-পিঠে তৈরি করেছিলেন। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বিদ্যমান ছিল ।
সুলতান ডিগ্রিধারী না হলেও যথেষ্ট বিদ্যা-বুদ্ধি তার ছিল । ওস্তাদের মৃত্যুর পর তিনিই দলের কর্ণধার হন । পাগলা কানাই শিষ্যবৃন্দের মধ্যে সুলতান মোল্লাহ ছিলেন একমাত্র ‘ষড়চক্র’ ভেদ- বিচারের সাধক । দুই প্রধান শিষ্যের মধ্যে ইদু বিশ্বাস কবিত্ত্বে ও সুলতান সাধনায় লব্ধ প্রতিষ্ঠিত। তার সম্পর্কে ওস্তাদের ধারণা ছিল অনেক উচ্চে। তার পদে আমরা দেখতে পাই,
“কানাই কয় ওরে সুলতান, তোর যেমন মন,
যে ভাবেতে গাস জারী, পছন্দ আছে ভারী,
ধুয়ো বান্দে মুলুক ছান্দে নাম জারী”। (১২০ নং পদ)
প্রিয় শিষ্যকে তিনি সর্বদায়ই আদেশ উপদেশ দিয়ে উপযুক্ত করে তুলেছিলেন । এবং মারফতির সর্বোচ্চ শাখায় বিচরণ করিয়েছেন। যেমন-
“ উল্টো
কুল আর বিসমিল্লাহ,
বিপদের না ঠেকবি জ্বালা ।
২৪ চান্দের ভেদ গা জেনে নেও বাবা- কোন চান্দে হয় কোন চান্দ উজালা ।
৬ রতির ভাগ জানে শুনে-
হগা যামোল্লার বিটা মোল্লাহ্” । (১২০ নং পদ)
আবার সুলতানের পদে দেখা যায়,
“ও তায় ওস্তাদ আমার পাগলা কানাই কয়েছে ।
হস্ত ধরে ষড় চক্র শিখাইছে ।
ভাঙ্গিস নে লোকের কাছে রে সুলতান-
যাবি তুই দিন কতক কাল বাঁচে” । (পরিঃ ৩৪ নং পদ ।)
ওস্তাদের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা বোধের ধারণা এত বেশি ছিল যে পরবর্তিকালে ত তাদের সম্মান রক্ষার্থে নিজ জীবনের মায়া তুচ্ছ করেছেন। এ সম্পর্কে কবি পৌর আমাদের শ্রদ্ধেয় ঝিনাইদহ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব মোঃ মোশাররফ হোসেন সাহেব ও শ্রুতি মোতাবিক জানা যায় যে, সুলতান মোল্লাহ্ ওস্তাদের মৃত্যুর পর কর্ণধার রূপে দেশ-বিদেশ পান করে বেড়াতেন । একবার ঢাকার নিকট কোন এক জমিদার বাড়িতে পাল্লা করার সময় বিপক্ষ দল পরাজিত হয়ে ‘ষড়চত্র’ ভেদের গান করেন ।
সুলতান বড়ই সংকটে পতিত হলেন। আসরে গানের উত্তর না দিলে ওস্তাদের কলংক ও সম্মান হানি হবে ভয়ে ‘জান দেব মান দেব না’ গ্রহণ করেন। তিনি ওস্তাদের-“ভাঙ্গিসনে লোকের কাছে রে সুলতান, যাবি তুই দিন কতক কাল বাঁচে” এই উপদেশ অমান্য করে ষড়চক্র ভেদের গান করলেন। উত্তর করার আগে জমিদার সাহেবকে অনুরোধ করে বললেন, “জমিদার সাহেব গানের শেষে।
আমি আর বেঁচে থাকব না। আমাদের বিদায় করুন” । শিষ্যদের অতি দ্রুত বাড়ি পৌঁছে দেবার হুকুম করেন । ভেদ ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে সুলতানের গলা দিয়ে হড় হড় করে রক্ত উঠতে থাকে। ধরাধরি করে আসরের বাইরে আনা হল । এমন সময় বাড়ি থেকে খবর এলো যে তার একটা পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। প্রকাশ থাকে যে, ওস্তাদ পাগলা কানাই কর্তৃক ভবিষ্যৎ বাণী ছিল এই, তোর ৭টা সন্তান হবে সত্য।
তবে, শেষ সন্তান কন্যা হলে তোর শতাধিক বছর আয়ু হবে। অন্যথায়, তুই পুত্র সন্তান জন্মের সংবাদ শোনা মাত্রই তোর মৃত্যু হবে। চোখের দেখা পাবি না। দেখতে পেলে মৃত্যু হবে না । হলও ঠিক তাই। পুত্র লাভের সংবাদ শোনা মাত্রই পুনঃ রক্ত বমন শুরু হল । শিষ্যদের বললেন, আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছনোর ব্যবস্থা কর। আমার স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দেখা করাতে পারলে, আমি বেঁচে যাব । দ্বিগুণ শক্তি ও উৎসাহের সঙ্গে নৌকা চলতে থাকে ।
কিন্তু বিধি বাম । ৫ম দিনে ভোর নাগাদ শৈলকুপা থানার ফাদিলপুর ঘাট পর্যন্ত পৌছাতে পারলেন। তার ইচ্ছা মতই প্রধান শিষ্য পদমদীর এরশাদ আলি সকলের সাহায্যে বাড়িতে পৌঁছে দেন। হোমিও ডিসপেনসারি ও হুজরাখানার পার্শ্বে নিজ হস্ত রোপিত কাঁঠাল গাছের দুই হাত দূরে অগ্নি কোনে দাফন করা হয় ।
মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে আমরা ভিন্ন মত পোষণ করি । কবি সুলতান মোল্লাহর মৃত্যু কাল ১৩০০ সালের ১লা চৈত্র বা একদিন আগে বলে কবি পৌত্র জনাব মোশাররফ হোসেন যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য। কবি ইদু বিশ্বাস ১নং পদ ও ২৭ নং পদ এবং পরিশিষ্ট ৫৩ নং পদে ভগবান নগরের তাইজদ্দি মোল্ল্যা যে পদ রচনা করেছেন তাতে বিস্তর গরমিল দেখা যায়। আমরা এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করি ।
সুলতান মোল্লাহর মৃত্যুর পর দলবল সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। ওস্তাদের মতই তিনি অসিয়ৎ করে যান। উভয়ের অসিয়ৎ ছিল, আমার মৃত্যুর পর তোরা (পুত্রগণ) আর গান করিসনে । কার কাছে কোথাও হেরে যাবি, মান অপমানের কথা শুনবি । তোদের সাথে আমার নামও তলিয়ে যাবে। এদের বংশধরেরা এ অসিয়ৎ পালন করে আসছেন।
একবার কবি পাগলা কানাইয়ের জীবিত থাকা কালে সুলতান মোল্লাহ ও ইঁদু বিশ্বাসের সংগে এক পাল্লা গান হয়। আসরে উঠে ইদু বিশ্বাস সুলতান মোল্লাকে মোটেই আমল দিচ্ছিলেন না । সুলতানকে অত্যন্ত হীন চোখে দেখতে থাকেন । কিন্তু সুলতানকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারলেন না। শেষ ষড়চক্র সম্পর্কে এক ভুল গান পরিবেশেন করে পরাজিত করতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুলতান ইদু বিশ্বাসের ভুল ধরে এক গান রচনা করে গাইলেন,
“নামটি ইদু গানটি মধু বেশ,
তোমার আসলেই যায় ভুল ।
তবে কেন এত ভুলে,
গানটি সভায় গাইলে,
এ কথা না করে স্থূল (পরিশিষ্ট ৩৭ নং পদ । )
বিচারে ইদু বিশ্বাস পরাজিত হলেন । কবি সুলতান মোল্লাহ ডিগ্রিধারী না হলেও বেশ কিছু লেখাপড়া জানতেন । তিনি বাংলা ছাড়াও কিছু আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা জানতেন । পিতার মত তিনিও গ্রামের মসজিদে ইমামতি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
বংশ পরম্পরায় এই মোল্লাহ বংশ ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন । একদিন কোন এক জলসায় ওস্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। উভয়ের আলাপ- আলোচনায় সুলতান কবি পাগলা কানাইয়ের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আদর্শের প্রতি মুগ্ধ হন। আস্তে আস্তে তিনি কবির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সুলতান কবির প্রৌঢ় বয়সের শিষ্য ছিলেন । কবিও তাকে নিজের মত করে গড়ে তোলেন।
মরমী কবি সুলতান মোল্লাহ / বয়াতি আনুমানিক ১২৪৯/৫০ বাংলা সন তার মাতুলয়ে ঝিনাইদহ শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত কাঞ্চনপুর গ্রামে জনু করেন। তার পিতা মুন্সি আলিমুদ্দিন ও পিতামহ মুন্সি নাজিমুদ্দিনের পৈতৃক নিবাস ছিল অত্র শহরের উত্তরে আড়য়াডাঙ্গা গ্রামে।
নাজিমুদ্দিনের দুই পুত্র-অছিমুদ্দিন ও আলিমুদ্দিন। উভয়ে বাংলা, আরবি ও ফার্সি শিক্ষা লাভ করেন । পূর্ণ শরীয়তের পাবন্ধ ছিলেন এরা । আলিমুদ্দিনের দুই পুত্র- সুলতান ও ইরফান। পিতা উভয়ের শিক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী প্রাম বাসুদেবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন । এখান থেকে তিনি ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ সমাপ্ত করেন । কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় কবির ১২/১৩ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগ হয় । চাচার অভিভাবকত্বে দুই ভাই মানুষ হতে থাকেন ।
পিতৃহারা বালকের প্রায়ই মাতুলয় কাঞ্চনপুর যাতায়াত ছিল । এখানে এসে তিনি কানাই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কোন এক আসরে আলাপও হয় দুজনের । মাতুলয়ের নাম করে প্রায়ই তিনি চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের গানের আসরে উপস্থিত হতে থাকেন । এই ভাবে তিনি কানাই ভক্ত হয়ে পড়েন । শেষ পর্যন্ত বাড়িতে অজানা রেখেই কবি পাগলা কানাইয়ের নিকট শিষ্যত্ব লাভ করেন । কবিও তাকে মনের মত করে সঙ্গীত জগতের সর্ব শাখায়, দেহ তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক তত্ত্বে শিক্ষা দেন ।
কবি সুলতান মোল্লাহর ৭ পুত্র। কন্যা ছিল না। পুত্রদের নাম হেলাল উদ্দিন, নেহাল উদ্দিন, আয়নুদ্দিন, জয়নুদ্দিন, হাতেম আলি, ইউছুপ আলি ও কেয়ামুদ্দিন ।
কবির আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। আর্থিক দৈন্যতার মধ্যেও তিনি ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি একজন ভাল হোমিওপ্যাথিক ছিলেন। এতে তিনি সচ্ছলতা ফিরেও পান। ডাক্তারির এই ধারা সদর থানার সামনে (আল হেলাল হোমিও হল) এ বংশের ডাঃ তোফাজ্জেল হোসেন সুনামের সহিত ডাক্তারি করছেন।
প্রকাশ থাকে যে, তোফাজ্জেল হোসেন লেখকের সহপাঠি এবং নেহাল উদ্দিন পুত্র বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জনাব মোশাররফ হোসেন সাহেব লেখকের শিক্ষক । এই অধ্যায়ের তথ্যগুলি উক্ত শিক্ষকের অনুমোদন প্রাপ্ত ।
পরিণত বয়সে (২১) ওস্তাদ পাগলা কানাইয়ের দ্যুতির মাধ্যমে মাতুল গ্রামের ফারাজতুল্যা জর্দার এর কন্যা আরেজান নেছা (৭/৮) কে বিয়ে করেন । বিবাহের পর তিনি ওস্তাদের নিকট সর্ববিদ্যা শিক্ষা লাভ করেন। এবং পাল্লা করে বেড়ানোর অনুমতি লাভ করেন। তার প্রাপ্ত শাল, ঘড়া, থালা-কাসা পৌর মোশাররফ হোসেনের নিকট রক্ষিত আছে । তা ছাড়া অত্র কবির দাদা নাজিম উদ্দিনের হস্ত লিখিত কোরআন শরীফ গচ্ছিত আছে।
কবির কণ্ঠ অত্যন্ত উচ্চ ছিল। বহুদূর পর্যন্ত সে কণ্ঠ মানুষকে বিমোহিত করত। এবং ওস্তাদের মহান বাণী দূর দূরান্তে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে ওস্তাদের পালি দোহার পদমীর এরশাদকে প্রধান পালি দোহার করে পাল্লা গান শুরু করেন ।

দির্ঘাঙ্গা শ্যাম বর্ণের এই লোকটার মুখে ঘন চাপ দাড়ি, মাথায় সাদা টুপি, কান বারবী চুল, পরণে থাকত সাদা লুঙ্গী-পাঞ্জাবী । মুখে নিত্য হাসি। শরীয়ত পন্থী সুলতান মোল্লাহ মারফতি, তরীকতি, হাকিকতির সকল শাখায় বিচরণ করেও তিনি কখনো শরীয়তকে ভুলে যান নি । তার কথায়-
“আর শোন ভাই মোহাম্মদের বাণী-
নামাজ পড় সকলি-
শহরেতে পয়দা হল কলমা কর জারী”
এককথায় আমরা বলতে পারি যে কবি সুলতান মোল্লাহ ছিলেন উপযুক্ত ওস্তাদের উপযুক্ত শিষ্য। অর্থাৎ ওস্তাদের সর্ব প্রকার গুণই তিনি ধারণ করতে পেরেছিলেন ।
আরও দেখুন :
