আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় সহোদর উজোল শেখ। চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের নাম বলার সাথে সাথে সহোদর উজোলের নামটাও এসে যায় । তিনি কবির দু’বছরের ছোট ছিলেন। দু’ভাই ছিলেন আজীবন একে অপরের বন্ধু । সত্য কথা বলতে গেলে তিনিই ছিলেন পাগলা ক্যানইয়ের গানের উৎস। কারণ, উজোলের বাদ্য ছাড়া কোন আসরই জমজমাট হোত না। কথিত আছে যে, উজোল এক সংগে ১৪ টা বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার করতে পারতেন |
কালীদহের ধারে বড় ভাইয়ের সংগে গরু-বাছুর চরাতে যেতেন । মাথায় থাকতো তালের ছাতি । ঐ ছাতির কুড়ার উপর হাত বুলিয়েই তিনি বাদ্য শিক্ষা করেন । এর জন্য কারো কাছে যেতেও হয়নি বা কোন ওস্তাদও ছিল না। প্রকৃতিই তাদের দু’ভাইয়ের ওস্তাদ । ছাতির কুড়া, খাবারের থালা, পানির কলস, মাটির হাঁড়ি প্রভৃতি বাঁজিয়ে তিনি বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার শিখেন। পরবর্তী কালে তাকে আমরা এমন একজন উঁচু দরের বাদ্যকর হিসাবে পাই যে, বহু সৌখিন ও পেশাগত বাদ্যকরও তার কাছে হার মেনেছে ।
বস্তুত, এমন একজন বাদ্যকর কবি পাগলা কানাইয়ের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তা না হলে হয়তো বা তার কাব্য ও সুরের জগতে দেশ জোড়া খ্যাতি অর্জনে ব্যাঘাত ঘটতো। ‘বাংলার গান’ নামক পুস্তকে শ্রী দূর্গাদাশ লাহিড়ী মহাশয় যে কানাই সুর’ বলে এক নতুন ও অভিনব সুরের উল্লেখ করেছেন তার পেছনে উজোলের কৃতিত্ব কম ছিল না ।
একবার নগরবাথান কুঠির মালিক জেমস্ টুইডি সাহেবের দেওয়ান বা ম্যানেজার বেড়াদিয়া গ্রামের রাম কেশব বাবুর বাড়িতে এক গানের জল্সা হয় ।
কলিকাতা থেকে আগত জনৈক মতিলাল বাবু তাঁর যাত্রা পার্টি নিয়ে উপস্থিত ছিলেন । তিনি উজোলের বাদ্যের সুরে মুগ্ধ হয়ে তাকে কলিকাতায় মাসিক ১০০ টাকায় নিয়ে যেতে চান । কিন্তু উজোল সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
মান বড় না জান বড় চিন্তা করে তিনি আর গেলেন না। উজোল ছিলেন ধীর-স্থির-ভাবুক প্রকৃতির । চুপচাপ থাকা তিনি পছন্দ করতেন। বেশী কথা বলতেন না। ভাবের রাজ্যে ছিল তার আনা-গোনা । আধ্যাত্মিক শক্তিতেও ছিলেন একজন উঁচু দরের সাধক। একবার এক ভাদ্রের বর্ষায় মাঠের ধান-পাট সব তলিয়ে যাবার উপক্রম হয়।
একমাত্র পুত্র খোরশেদ বোনকে দেখতে নারিকেল বাড়িয়া যান। এদিকে ধান কাটার আশু প্রয়োজন । তিনি বাড়ির পূর্ব দিকের ফাঁকা মাঠে গিয়ে ছেলের নাম ধরে উচ্চ স্বরে তিন বার ডাক দিলেন। ঐদিন সকালেই খোরশেদ বাড়ি। ফিরছিলেন ।
বেড়বাড়ি থেকে প্রায় ৮ মাইল দূরবর্তী হামদরডাঙ্গা গ্রামের মার্কেন মধ্যে এসে তিনি পিতার ডাক শুনতে পান এবং তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসেন। উজোল খুব মাছুড়ে ছিলেন । মাছ ধরা ছিল তার একটা বড় বাতিক । দূর-দূরান্তে গান করতে গিয়েও তিনি মাছ ধরতে যেতেন । একবার তিনি মুরারীদহ গ্রামে গান। করতে গিয়ে নবগঙ্গায় বড়শীতে মাছ ধরতে যান । ভোররাত্রে একটা বড় রুই মাছ ধরা পড়ে ।
গ্রামের জমিদার সলিম উল্লাহ চৌধুরী অতি প্রত্যুষে একখানা নৌকায় চড়ে নদীতে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন । উজোলের কোন দিকে খেয়াল নেই । তিনি মাঝিকে কড়া মেজাজে ঘুরে যেতে বলেন। জমিদার সাহেব কণ্ঠস্বরেই চিনে ফেললেন। তিনি মাঝিকে পাঠালেন উজোলের সাহায্যে। উজোলও খুব লজ্জ্বা পেলেন। মাছটা প্রায় ২০/২২ সের ওজনের ছিল। তিনি মাছ নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত হলেন ।
দলের সবাই জমিদার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে ফিরলেন 1 চারণ কবি পাগলা কানাই একবার বহুদিন ধরে একটা জারী গান রচনা করেন। মনের মতো করে তাতে তাল, লয়, মাত্রা, ছন্দ, ভাব, ভাষা ও সুর দিয়ে ছিলেন। একথা উজোল জানতেন । কথায় কথায় তিনি ব্যাপারটা ফাঁস করে দেন। কবির এই গুপ্ত পদের সন্ধান পেয়ে পাগলা কোরেশ ও হিরাজতুল্লাহ্ উজোলকে ফাঁকি দিয়ে গানটা বের করে নেয়।
তারা এক সভায় ঐ গানটা প্রকাশ করে দেন। ফলে, আসল সম্পদ যার সেই কবি পাগলা কানাই ফাঁকে পড়ে গেলেন। কবি কাউকে কিছু বললেন না। মনের দুঃখে এই পদ খানা গাইলেন মাত্র-
“একটা বছর ধরে সুর দিয়ে তৈয়ার করে,
চাছে ছুলে থুইছি তুলে ফুরছি হুকোর নল ।
হাতের লাঠি পড়ে গেছে কানাইর বিদ্যা বুদ্ধি বল ।
উজোলের পরামিশে, ভেবে আর পাইনে দিশে,
গোপনে পাগলা কোরেশ টিপে দেছে কল” ।
(১১৫ নং পদ।)
এ সব ঘটনা যাই হোক না কেন উজোল বড় ভাই কে যেমন ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতেন তেমনি কবিও ছোট ভাইকে গভীরভাবে ভালবাসতেন । ছোট ভাই উজোল ছিল কবির দু’বছরের ছোট । কিন্তু তিনি কবির আগেই ১২৮০ সালের ১লা বৈশাখ ইস্তেকাল করেন । কবির ভাষায়-“চৈতের শেষে বৈশাখ মাসে মলো সোদ্দের ভাই।
চিরকালের সুখ-দুঃখের ভাগী ছোট ভাই উজোলের মৃত্যুতে কবি অত্যন্ত ব্যাথা পান। সে ব্যাথা তিনি চাপা দিয়ে রাখতে পারেন নি। তাই কবি সুরের সাহায্য বহু বার শোক প্রকাশ করেছেন । “আজ ভাই মরিয়া এত দুঃখ আমার কপালে । উঠে আয় আয় ও মিয়া ভাই বলে”” । “না জানি কোন সময় কি করি । উজোল ছিল মরে গিয়েছে, আমার আর না আছে দেরী”-১২০ নং পদ ।
এতে সহজেই আমরা বুঝতে পারি যে, দু-ভাইয়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ত বোধ অত্যন্ত গভীর ছিল । এ গভীর হৃদ্যতা বড়ই দুর্লভ। উজোলের এক মাত্র পুত্র খোরশেদ বেশী বয়স পান নি । নাবালক পুত্র জামাত আলি নারিকেল বাড়িয়া ফুফুর নিকট চলে যান । সেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেন ।
Table of Contents
সহোদর উজোল শেখ

সহোদরা সরনারী
কবি পাগলা কানাইয়ের জীবনের সাথে ওৎপ্রোত ভাবে জড়িত যে স লোকের নাম করতে হয় তাদের মধ্যে কবির জেষ্ঠ্যা ভগিনী সরনারী অন্যতম সরনারী কবির ৭/৮ বছরের বয়জেষ্ঠ্যা ছিলেন। সম্ভবতঃ বেড়াদিয়া গ্রামে মাতুলয়ে তার জন্ম হয় । একমাত্র সন্তান সরনারীকে কামাল উদ্দিন নামে এক উচ্চ মধ্যবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত ঘরে বিয়ে দেন। তার পিতা গ্রামের একজন মোড়ল ব্যক্তি ছিলেন । সত্য নিষ্ঠ ও পরোপকারী হিসাবে যথেষ্ঠ খ্যাতি ছিল তার ।
কবির পিত কুড়োন শেখ জন্মভূমি-মাধবপুর থেকে বেড়বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ কালে কামাল উদ্দিনের পিতা কর্তৃক যথেষ্ঠ সহযোগিতা পান । ক্রমে দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্ঠ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। কালে, সরনারীর রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়ে একমাত্র সন্তান কামালুদ্দীনের সাথে বিয়ে দেন । কামাল উদ্দিন সাহেব মাত্র ২৭ বছর জীবিত ছিলেন। মৃত্যুকালে একমাত্র কন্যা বেগম আরা । বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর ।
সরনারী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও সাহসীনী মহিলা ছিলেন। তিনি স্বামীকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন। স্বামীর মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন কিন্তু ভেংগে পড়লেন না ।
সরনারী ছিলেন অত্যন্ত রূপবতী ও গুণবতী। পরীর মতো খুবসুরাত ছিলেন তিনি । রূপের মোহে ও স্বামীর ধন-সম্পত্তির লোভে অনেকেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠান ।
বাংলা ১২১৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২০/২৫ বছরের মতো। এসময় উজোল কানাইয়ের বয়স মাত্র ৬-৮ বছর। পিতা ও স্বামীকে হারিয়ে কন্যা ও ভাই দুটিকে নিয়ে তিনি অকুল সমুদ্রে পড়লেন । পাণি গ্রহণকারী অনেকেই ভয়-ভীতি দেখাতে থাকে। তবুও দ্বিতীয় বার দ্বার গ্রহণ করলেন না । বরং নাবালিকা কন্যাকে বিয়ে দিয়ে নিজ বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করলেন ।

জামাই ছেফাতুল্লাহ্ মন্ডল ছিলেন বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত সাহসী, কর্মঠ ও সৎ। সে সময় এমন একজন সৎ-সাহসী ব্যক্তিরই প্রয়োজন ছিল এ পরিবারে। তার কর স্পর্শে অতি অল্প দিনের মধ্যেই আবার পরিবারে সুখ-শান্তি ফিরে আসে। বিধি আমার বাধ সাধলেন । সুখ-শান্তি এ পরিবারের ধাতে সইলো না । কিছুদিন পর আবার দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো। সে এক মহা দুর্যোগ ।
একদিন ছেফাতুল্লাহ মাঠে হাল চাষ করানোর সময়ে জমির সীমানা নিয়ে জনৈক ব্যক্তির সাথে গোলযোগ হয় । অন্যায় সহ্য করার ক্ষমতা ও ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় রাগের বশবর্তীতে, লাঙ্গলের এক আঘাতেই ঐ লোকটাকে মেরে ফেলেন। ফলে, ছেফাতুল্লাহ্র দ্বীপান্তর হয়। দশ বছর পর ছেফাতুন্না মণ্ডল বাড়ি ফিরে আসেন । এই দশ বছরে তার শরীর-মন উভয়ই ভেঙ্গে পড়ে। ইতোমধ্যে কামাল উদ্দিনের সমস্ত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হয়ে যায় ।
দুর্যোগ পূর্ণ সংসারকে তিনি আর সু-সংগঠিত করতে পারলেন না । কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন । মৃত্যুকালে তিনি দুই পুত্র মদন ও সাদেক এবং স্ত্রী বেগমকে রেখে যান । দু’বছরের মধ্যে মদন-সাদেকও মৃত্যু মুখে পতিত হয় । সরনারী অকুল পথারে পড়লেন ।
এভাবে মৃত্যুর পর মৃত্যু এসে সরনারীর সোনার সংসার ছার-খার হয়ে গেল । ২০ বছরের বিধবা কন্যাকে নিয়ে তিনি সত্য সত্যই মুছিবতে পড়লেন । কন্যা মায়ের মতই রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন। তিনিও আর দ্বিতীয় পাণি গ্রহণ করলেন না ।
এ সময় পাগলা কানাই ধুয়ো-জারী গানের জগতে পরিচিত হয়েছেন মাত্র । তিনি বোন ও বোন-ঝিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। যে সরনারী একদিন যে ভাইদের আশ্রয় দিয়ে ছিলেন, আজ আবস্থার বিপাকে পড়ে তাদেরই আশ্রয় গ্রহণ করতে হলো। সংসার অভাব অনটন কমে আসলো। তিনি সংসারের হাল ধরলেন । মা, বোন, ভাগ্নেয়ী ও ছোট ভাই উজোল কে নিয়ে তিনি (পাগলা কানাই) পুনঃসংসার যাত্রা শুরু করলেন ।

কবি পরিবারে বোন-ভাগ্নেয়ী বড়ই সুখে দিন কাটাতে থাকেন। কবি ভ্রাতৃদ্বয়কে সরনারী মাতৃ স্নেহে প্রতিপালন করেছিলেন। সে স্নেহ আরও গভীরতর হলো । কবির বাক্যে ও সম্পর্কে আমরা দেখতে পাই-
“ওরে রজনী প্রভাত কালে,
বুন আমার কান্দে বলে,
ওঠ ওরে নীল মনি-
কেনো বেহুশ হলি ।
আমার মাথায় দিয়ে দুঃখের ডালি ।
তুই আমারে ছাড়া চললি ভাইরে,
দেখনা নয়ন মেলি” । (১১৩ নং পদ ।)
কবি সংসারে বোন সরনারীই ছিলেন গৃহকর্ত্রী । কবি ভ্রাতৃদ্বয় দু-চার মাস বাড়িতে না আসলে তিনিই সংসার দেখা শোনা করতেন । কবির বাড়িতে চাষ-বাস ছিল । সরনারী এ সব কিছুর হিসাব নখ-দর্পনে রাখতেন । সত্য কথা বলতে কি. সরনারী কবি ভ্রাতৃদ্বয়ের বড় বোনই ছিলেন না, তিনি তাদের পিতা-মাতার অভাব বহুলাংশে পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আরও দেখুনঃ
