গোড়ার কথা

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় গোড়ার কথা। কুড়ন শেখ ছিলেন অমর আত্মা ‘শেখ সাদী(রঃ)’ এর কয়েক পুরুষ অধঃস্তন একজন সহজ সরল ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। এই বংশের কোন এক মহৎপ্রাণ ব্যক্তি ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুদূর সিরাজ নগর থেকে এদেশে পাড়ি জমান। তৎকালীন ইসলামি রেনেসাঁর যুগে ইসলাম প্রচার, প্রসার ও বিভিন্ন প্রকার শিক্ষামূলক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রতিযোগিতা মুসলমানদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল।

 

গোড়ার কথা

 

গোড়ার কথা

শেখ পরিবারও এই মহৎ কাজে সাড়া দিয়েছিলেন । এই অমর আত্মা কখন কোন সময় এদেশে আসেন তা সঠিক করে বলা যায় না । তবে, সম্ভবত তুর্কি সালতানাতের প্রথম দিকে অন্যান্য ধর্ম প্রচারক ফকিরদের সংগে তিনিও এদেশে আসেন। যাই হোক, পথ চলতে চলতে তিনি নগরবাথান কর্ণসার্নাধীন মাধবপুর-নেবুতলা গ্রামে এসে উপস্থিত হন।

তৎকালে, “ক্ষরস্রোতা বেগবতী নদী (ব্যাং নদী) এবং প্রবহমান নবগঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চল এক উন্নত সভ্যতা ও সমৃদ্ধ অঞ্চলে পরিগণিত হয়েছিল। কারণ, নবগঙ্গা আর তার শাখা ব্যাং নদী কুমারের জলে সঞ্জীবিত হইয়া স্বচ্ছ সলিলে উভয় কূলে সোনা ফলাইয়া যশোহর জেলার উত্তরাংশের যথেষ্ট শ্রীবৃদ্ধি করিয়াছিল । ইহার সুধাসম স্বাদুনীর স্বাস্থের পক্ষে পরম উপাদেয়। ইহার তীরভূমিতে অপরিমিত শস্য ফলে ।

খাদ্য দ্রব্যের দুর্গতি সর্বত্র হইলেও এখনও নবগঙ্গার পার্শ্ববর্তী স্থানের লোকে মস- দুগ্ধের তেমন অভাব বোধ করে না” । এমন সুন্দর স্থান কার না পছন্দ হয়? এখানে এই হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে ধর্ম প্রচার কার্য চালাবার উদ্দেশ্যে ফকির সাহেব বসতি স্থাপন করেন। নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন এই পীর সাহেবের সুমধুর ব্যবহার ও উত্তম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে খুব অল্প দিনের মধ্যেই অত্র এলাকা ও দূর-দূরান্তের বহু লোক তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তিনি অত্যন্ত পণ্ডিত ও বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন।

দিনে দিনে মুরীদানের সংখ্যা বৃদ্ধিতে হিন্দুরা সংকিত হয়ে পড়ে এবং মুসলমানদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধিতে অত্যন্ত ঈর্ষা পরায়ণ ও ভীত হয়ে পড়ে। কথিত আছে, পরম শত্রুরাও পীর সাহেবের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও তেজস্বীয়তার কারণে সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতে সাহস করেনি। ফলে নানা ভাবে শত্রুতা করতে শুরু করে। এমনি শত্রুতা ও হিংসার মধ্য দিয়ে ‘বেনিয়া রাজ্যের সূত্রপাত হয় ।

মুঘল আমলের শেষ দিকে এই পীর বংশের জৌলুস আর ছিল না । ধূর্ত ক্লাইভের দ্বৈত শাসন ও ‘৭৬ এর মন্বন্তরে বাংলাদেশের চরম অবস্থায় এই পরিবারটি সর্বহারা হয়ে পড়ে। এছাড়া আস্তে আস্তে প্রকৃত শিক্ষার অভাবে পরিবারটি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।

মাধব শেখ ছিলেন এই সময়ের একজন খ্যাতনামা পুরুষ। তিনি অত্যন্ত সহজ- সরল ও ধর্মভীরু এবং দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন। তার নামে মাধবপুর গ্রামের নামকরণ হয়েছিল। তিনি পূর্ব হিংসা নিবারণার্থে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীদের সাথে হাত মিলাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই এই বংশ পরম্পরা ঈর্ষা দূর করতে পরলেন না। বরং নানাভাবে অপমানিত হয়ে এক রাশ দুঃখ ও হতাশা নিয়ে ফিরতে হলো ।

মাধব শেখের পুত্র গোলাব শেখ ছিলেন একজন তেজস্বী পুরুষ। এই গোলযোগের সূত্র ধরে তাকে একবার জমিদারের লাঠিয়ালরা ধরে নিয়ে যায় এবং বিচারে জরিমানা হয়। পরিণত বয়সে সেলিম শেখ নামে এক পুত্র সন্তান রেখে মারা যান । কিন্তু কেউ আর এই জিদ ও ঈর্ষা পূর্ণ গোলযোগ নিষ্পত্তি করে যেতে পারলেন না।

সেলিম শেখের পুত্র মেছের শেখ সাধাসিধে জীবন-যাপন পছন্দ করতেন। মোটামুটি ভাবে সুখেই তিনি ছিলেন । অত্র অঞ্চলের লোকের জন্য তিনি একটি ‘হাট’ স্থাপনের উদ্দেশ্যে কয়েক বিঘা জমি দান করেন। পরবর্তীকালে ঐ হাট ভেঙে কুঠিয়ালদের প্রচেষ্টায় নগরবাথান স্থাপিত হয়। যা ‘কলিকাতা গেজেটের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মাধবপুর আজও মেছেরের হাটখোলা / হাটখোলার মাঠ নামে একটি মাঠ বিশেষভাবে পরিচিত।

মেছের শেখের দুই পুত্র, কুড়োন শেখ আর জুড়োন শেখ। এঁরা ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ। কোন প্রকার ঘোর-প্যাচ এদের মধ্যে ছিল না। এ সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ব্যাপক আকারে প্রবর্তিত হলো কুখ্যাত নীল চাষ । গরীব চাষাদের উপর নীলকরেরা স্বার্থ সিদ্ধির হীন আশায় শুরু করে অত্যাচার ও নিপীড়ন। আর এ সুযোগ গ্রহণ করে এক শ্রেণির হিন্দু শোষক দল। এদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলার প্রতিটি পরিবারকে হতে হয় সর্বহারা।

আমাদের আলোচ্য শেখ পরিবার ছিল এর মধ্যে অন্যতম । এ সময় নগরবাথান নীলকুঠির এক সাহেবের অনেকগুলি গাভী ছিল । গাভীগুলি প্রায় সময় ছাড়া থাকতো। মাঠের ফসলাদি তসরূপ করতো। সাহেবকেও বলে কোন কাজ হলো না। এ নিয়ে একদিন গ্রামের লোকেদের সাথে সাহেবের লোকেদের বিরাট একটা বচসাও হয়ে গেল । কিন্তু সাহেব কিছুতেই ক্ষান্ত হলেন না।

বরং কুড়োন শেখকে হোতা বিবেচনা করে জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে শাসিয়ে গেল। শেষে এক পর্যায়ে, “গ্রামবাসীগণ বিরক্ত হয়ে এক রাতে গাভীগুলির লেজ কেটে দিল”। আর যায় কোথা-‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’। সাহেব কুড়োন শেখ ও কয়েকজনের বিরুদ্ধে নালিশ করে মোটা অংকের ডিক্রি চাপিয়ে দিল । শেষে, উপায়ন্ত না দেখে কুড়োন শেখ ‘মামুদশাহী পরগনা’র ‘নড়াইল এস্টেট’ ছেড়ে দিয়ে নলডাঙ্গা এস্টেট’ এর অধীন বেড়বাড়ি গ্রামে আশ্রয় নিলেন।

ঘটনাটি ঘটেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর সূচনাতে । এই সময়ে নলডাঙ্গার রাজা ছিলেন শ্রীমান রাম শংকর দেবরায় (১৭৭৩-১৮১২)। পদ্মনগরের জনাব বুদোই বিশ্বাস” ছিলেন রাজার খাস দেওয়ান । ভাটপাড়ার আদম লস্করের সাথে বুদোই বিশ্বাসের খুব বন্ধুত্ব ছিল। কুড়োন শেখ ভায়রা আদম লস্করের সংগে পরামর্শ করে উভয়ে বুদোই বিশ্বাসের শরণাপন্ন হলেন । বহু চেষ্টা-তদ্বির করে ডিক্রি রদ হল বটে কিন্তু মনের দুঃখে তিনি আর মাধবপুর ফিরে গেলেন না।

দুই ভাই স্থায়ীভাবে বেড়বাড়িতে বসতি হলেন । ভায়রা আদম লস্কর নিজের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তিনি ভাটপাড়া গেলেন না। কুড়োনের ভিটে নামে খ্যাত সে ভিটেই এখন আর কেউ বসবাস করে না”।

 

গোড়ার কথা

 

বেড়বাড়ির পরিচয়

বেড়বাড়ি ঝিনাইদহ থানাধীন একটি প্রাচীন, বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধশালী গ্রাম। পাঠান যুগে এখানে বাড়িবাথানের অক্ষয় কীর্তি ‘ঢোল সমুদ্র’ দীঘি খননকারী রাজা মুকুট রায় ‘খামার বাড়ি’ স্থাপন করেন এবং এখানে গবাদি পশু বেড় দিয়ে রাখতেন। এ জন্য এ গ্রামের নাম হয়েছে বেড়বাড়ি ।

বেড়বাড়ির উত্তরে রাজা মুকুট রায়ের পুরী রাজাপুর ও সৈয়দ শাহ এতিম উল্লাহ ১ প্রতিষ্ঠিত ফকিরাবাদ, দক্ষিণে কুলফাডাঙ্গা ও মায়াধরপুর। পূর্বে নলবিল ও ভড়ুয়াপাড়া, পশ্চিমে বানিয়াকান্দর ও কৃষ্ণপুর গ্রাম । বর্তমানে লোকসংখ্যা প্রায় তিন হাজার (২০১৬)। ৮ নং পাগলাকানাই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডভুক্ত একটি পূর্ণাঙ্গ মৌজা ।

মৌজা বই চারটি। পূর্বে ইহা বাড়িবাথান মৌজাভুক্ত ছিল । উত্তর- দক্ষিণে যে বড় রাস্তা দেখা যায় ইহাই পাগলা কানাই সড়ক নামে পরিচিত । যা উত্তরে রাজাপুর, বাড়িবাথান, গয়েশপুর, কোরাপাড়া, ব্যাপারীপাড়ার মধ্য দিয়ে ঝিনাইদহ শহরের কেন্দ্রস্থলে মিশেছে এবং দক্ষিণে কুলফাডাঙ্গা, মায়াধরপুরের মধ্য দিয়ে তেঁতুলতলা নামক স্থানে ঝিনাইদহ-যশোর হাই রোডে মিলিত হয়েছে।

এখানকার আবাদী জমা-জমি খুবই উন্নত শ্রেণির । অভাবী লোকের সংখ্যা খুবই কম । পাকিস্তান পূর্বে এখানে নাপিত, ধোপা, কামার, কুমার প্রভৃতি জাতির বসতি ছিল । এখন আর কেউ নেই। তাদের বসতি নাম শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। বর্তমানে গ্রামের সবাই মুসলমান ।

পাঠান, মুঘল, সুলতানী ও নবাবী আমলের রাস্তা-ঘাট বেশ উঁচু ও চওড়া। বর্তমানে পাগলা কানাই সড়ক পাকা সহ অন্যান্য রাস্তা-ঘাটের উন্নতি হয়েছে। ছোট-বড় বিভিন্ন নামের স্মৃতি বহন করে চলছে । পূর্বে শিক্ষার আলো ততটা ছিল না। শিক্ষা কেন্দ্র ছিল অনেক দূরে। স্বাধীনতা কালে সভ্যতার ছোঁয়াচে জনমনে শিক্ষার সাড়া জেগেছে। ফলে এখানে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি এবদেতায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

সরকার কতৃক পাগলা কানাইয়ের মাজার, পাগলা কানাই গণপাঠাগার ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি অডিটোরিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে (২০০৫)। বাংলাদেশ পূর্ব এখানে কবি কর্তৃক কয়েকটি তেঁতুল গাছ ও নারিকেল গাছ ছিল। এ গাছের ডাব-নারিকেল খেয়ে ‘৬৪ সালে পল্লী কবি জসিম উদদীন সাহেব ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন।

আবির্ভাব

বাংলা ১২০৯ সালের ২৫ শে ফাল্গুন রোজ সোমবার বেড়বাড়ি তথা বাংলার গৌরব রবি চারণ কবি পাগলা কানাই জন্ম গ্রহণ করেন। জীবনে একদিন মাত্র মাদ্রাসায় গমন করেন বলে শোনা যায়। তাই, তিনি নিরক্ষর ছিলেন কিন্তু অশিক্ষিত ছিলেন না। দু’বছরের ছোট উজোল শেখ নামে তাঁর এক সহোদর ছিলেন। পরবর্তীকালে জোড়-মানিক ও আজীবন সুখ-দুঃখের ভাগী ছিলেন দু’ভাই । স্বরনারী বলে কবি পাগলা কানাইয়ের এক বোন ছিল। বোন কবির বেশ কয়েক বছরের বড় ছিলেন।

কেউ কেউ অনুমান করেন স্বরনারী মাধবপুরেই জন্মগ্রহণ করেন এবং কেউ জন্ম বেড়বাড়িতে বলে মনে করেন। জামাই কামাল উদ্দিন বেড়বাড়ির বসতি । তার পিতার নাম জানা যায় না। তবে পাগলা কানাই- এর পিতা তার কর্তৃক অনেক উপকৃত হন । এই সখ্যতার কারণে মাত্র সাত বছর বয়সের কন্যা সরনারীর সাথে তার পুত্র কামালউদ্দিনের বিয়ে দেন। তাদের একমাত্র কন্যা বেগম জন্ম গ্রহণ করেন ।

পিতা কুড়োন শেখ ও মাতা মুমেনা খাতুন মধ্যবিত্ত ভদ্র ঘরের সন্তান। ধর্ম পরায়ণতার দিক থেকে এ পরিবারের যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। মাতা মুমেনা খাতুন সম্ভবতঃ বেড়াদিয়া গ্রামের মেয়ে ছিলেন। তিনি স্বতী-সাধ্বী ও অতিশয় ধর্মপরায়ণা মহিলা ছিলেন। কোন অতিথি-মেহমান বিনা জলযোগে ফিরতো না ।। এক কথায়, তার আচার ব্যাবহার ছিল আদর্শ রমনীর এক উজ্জ্বল প্রতীক ।

কবির পিতামহের নাম ছিল মেছের শেখ। মাধবপুরের মেছেরের হাটখোলা’ এখন তাকে স্মরণ করে । প্রপিতামহ গোলাব শেখ ও তার পিতার নাম ছিল মাধব। কবির মাতামহীর নাম ছিল বুড়ি নিছা। মাধরপুরের সে ভিটার পরিচয় এখনও পাওয়া যায়।

জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও বিভিন্ন প্রতিকুলতার কারণে কবির পিতার মন ও দেহ দুই-ই ভেঙে পড়ে। সকলকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে তিনি বাংলা ১২১৬ সালে মারা যান । তখন পুত্র কানাই সাত ও উজোল পাঁচ বছরের বালক মাত্র । নাবালক দুটি পুত্রকে নিয়ে মাতা মুমেনা খাতুন দুঃখের সাগরে পতিত হলেন ।

মক্তবে কবি

কবি পাগলা কানাই জন্মকাল থেকেই একটু দুরন্ত, চঞ্চল ও খেয়ালী প্রকৃতির ছিলেন । কারো কারো মতে, তাঁর প্রকৃতিতে মাঝে মাঝে একটু পাগলাটে ভাব দেখা যেত। কবির পিতা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি শিক্ষার মর্ম বুঝতেন। পার্শ্ববর্তী গ্রাম ফকিরাবাদে সৈয়দ শাহ এতিম উল্লাহ প্রতিষ্ঠিত মক্তবে ভর্তি করে দেন ।
যথারীতি দু’ভাই মক্তবে যেতে শুরু করেন। কিন্তু দু’চার দিন যায় মাত্র ।

কবি ছিলেন দুরন্ত, খেয়ালী ও গণ্ডি বহির্ভূত স্বভাবের। মক্তবের নিয়ম শৃংখলা ও আইনের শাসন তিনি মানতে পারেন নি। আশ্চর্য যে বাল্যকাল পেরিয়ে গেলে দেখা যায় কঠিন বাঁধনে নিয়ম শৃংখলাপূর্ণ তার নিরলস ঐকান্তিক জীবন। ছোট ভাই উজোল ছিলেন শান্ত ও নিরিহ মেজাজের। বড় ভাই বলতে তিনি ছিলেন অজ্ঞান। পরবর্তীকালে দেখা গেছে বড় ভাইয়ের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে, তিনি একশ টাকার বেতনেও ‘কোলকাতায়’ গানের দলেও কাজ করতে রাজি হন নি ।

সীমিত গণ্ডিতে মক্তবে পড়াশোনা করা কবির পক্ষে সম্ভব ছিল না । প্রকৃতি নিজেই যার শিক্ষার ভার গ্রহণ করেন তারা কি কখনও সামান্য একটা মক্তবের ধরাবাধা নিয়মে বাঁধা পড়তে পারেন। প্রকৃতির পাগল মক্তব ছেড়ে ছুটলো প্রকৃতির কোলে । উন্মুক্ত ময়দানে গিয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। দু’ভায়ের শিক্ষাকেন্দ্র হলো, প্রকৃতির বৈচিত্রপূর্ণ লীলা নিকেতন ।

 

গোড়ার কথা

 

সেখানে তিনি জীবনের সবকিছু পেয়ে ধন্য হলেন । ‘তার বড় পরিচয় তিনি একাধারে, লোককবি, সুরকার ও গায়ক। এছাড়া তাঁর আরও একটি বড় পরিচয় তিনি একজন আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন সাধক। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার গান বা কবিতাগুলি সংরক্ষণের তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় নি । তাই আজ বাঁশির ক্ষীয়মান সুরের মত আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে চলেছে মানুষের মন থেকে তার নাম”।

যাই হোক মক্তবের ক্ষুদ্র বেষ্টনী থেকে বের হয়ে তিনি প্রকৃতির কোলে এসে গাইলেন-(পরবর্তীকালে এই গানে লেখাপড়া না করার আক্ষেপ ধরা পড়েছে)

লেখা-পড়া শিখবো বলে পড়তে গেলাম মক্তবে।

পাগলা ছোঁড়ার হবে না কিছু ঠাট্টা করে কয় সবে ।

ছোঁড়া চলে তাডুম-তুডুম, মারে সবাই গাড়ুম গুডুম,

বাপ এক গরীব চাষা, ছাওয়াল তার সর্বনাশা,

সে আবার পড়তে আসে কোরান কেতাৰ ফেকাহ্ ।

পাগলা কানাই কয় ভাইরে পড়া হলো না শেখা।

ফলে এই দাঁড়ালো যে, কবি চিরকালের জন্য নিরক্ষরই রয়ে গেলেন । প্রকৃতি যার শিক্ষা গুরু, বর্ণ জ্ঞান তার কাছে গৌণ। কবির জীবনে এর যতার্থতা ও স্বার্থকতার পরিচয় মেলে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment