রামপ্রসাদ সেনের গান নিয়ে আজকের আয়োজন। “কবিরঞ্জন” রামপ্রসাদ সেন (১৭১৮ বা ১৭২৩ – ১৭৭৫) ছিলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট বাঙালি শাক্ত কবি ও সাধক। বাংলা ভাষায় দেবী কালীর উদ্দেশ্যে ভক্তিগীতি রচনার জন্য তিনি সমধিক পরিচিত; তার রচিত “রামপ্রসাদী” গানগুলি আজও সমান জনপ্রিয়। রামপ্রসাদের জীবন সংক্রান্ত নানা বাস্তব ও অলৌকিক কিংবদন্তি বাংলার ঘরে ঘরে প্রবাদবাক্যের মতো প্রচারিত। তবে নানা সূত্র থেকে তার জীবন সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যও পাওয়া যায়।
রামপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের এক তান্ত্রিক বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে। বাল্যকাল থেকেই কাব্যরচনার প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ লক্ষিত হত। পরবর্তীকালে তিনি তন্ত্রাচার্য ও যোগী কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তার রচিত ভক্তিগীতিগুলি তার জীবদ্দশাতেই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভে সমর্থ হয়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রামপ্রসাদ সেনের উল্লেখযোগ্য রচনা হল বিদ্যাসুন্দর, কালীকীর্তন, কৃষ্ণকীর্তন ও শক্তিগীতি।
বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীত ধারা বাউল ও বৈষ্ণব কীর্তনের সুরের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীর মিশ্রণে তিনি বাংলা সংগীতে এক নতুন সুরের সৃষ্টি করেন। রামপ্রসাদী সুর নামে প্রচলিত এই সুরে পরবর্তীকালেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম সহ বহু সংগীতকার গীতিরচনা করেছেন।
Table of Contents
রামপ্রসাদ সেনের গান :
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন রামপ্রসাদ সেন। তিনিই বাংলায় ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর লীলাকীর্তন শ্যামাসংগীতের ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। রামপ্রসাদ সেনই প্রথম কবি যিনি এই প্রকার গভীর ভক্তিসহকারে দেবী কালীর লীলাকীর্তন গান রচনা করেন। তার গানেই প্রথম কালীকে স্নেহময়ী মাতা এমনকি ছোটো মেয়ের রূপেও দেখা যায়। তার পরে একাধিক শাক্ত কবি এই কালীভক্তি প্রথাটিকে উজ্জীবিত করে রাখেন।
কীর্তন ও বাংলার লোকসঙ্গীত ধারার বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ বাংলা সংগীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন। পরবর্তী দেড়শো বছরে শতাধিক কবি ও সংগীতকার এই সুরে গান রচনা করেছিলেন। তার কাব্য ছিল “মধুর, আটপৌরে ও অসংস্কৃত”। যদিও এই সব গান লোকসুরের বদলে শাস্ত্রীয় ধারায় গাওয়ারই রীতি প্রচলিত ছিল। একই ধারায় সংগীতরচনাকারী তার দুই বিশিষ্ট উত্তরসূরি হলেন কমলাকান্ত ও মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
রামপ্রসাদের গান রামপ্রসাদী নামে পরিচিত। তৎকালীন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে এই কালীভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তার গানেও এই সকল ঘটনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই কারণে, তার জীবদ্দশাতেই গানগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।

আসুন দেখে নেই তার গানের সম্ভার:
হৃৎকমলমঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যামা
হৃৎকমলমঞ্চে দোলে করালবদনী শ্যামা ।
মনপবনে দুলাইছে দিবস রজনী ওমা॥
ইড়া পিঙ্গলা নামা, সুষুম্না মনোরমা।
তার মধ্যে গাঁথা শ্যামা, ব্রহ্মসনাতনী॥
আবির রুধির তায়, কি শোভা হয়েছে গায়।
কাম আদি মোহ যায়, হেরিলে অমনি॥
যে দেখেছে মায়ের দোল, সে পেয়েছে মায়ের কোল।
রামপ্রসাদের এই বোল, ঢোলমারা বাণী॥
রসনে, কালী নাম রটরে
রসনে, কালী নাম রটরে।
মৃত্যুরূপা নিতান্ত ধরেছে জঠরে॥
কালী যার হৃদে জাগে, তর্ক তার কোথা লাগে,
কেবল বাদার্থমাত্র ঘট-পটরে॥
রসনারে কর বশ, শ্যামানামামৃতরস,
তুমি গান কর পান কর, সে পাত্র বটরে॥
সুধাময়ী কালীর নাম, কেবল কৈবল্যধাম,
করে জপনা কালীর নামে, কি উৎকটরে॥
শ্রুতি রাখ সত্ত্বগুণে, দ্বি-অক্ষর কর মনে,
প্রসাদ বলে দোহাই দিয়া, কালী বলে কাল কাটরে॥
মায়ের এম্নি বিচার বটে
মায়ের এম্নি বিচার বটে।
যেজন দিবানিশি দুর্গা বলে, তার কপালে বিপদ ঘটে॥
হুজুরেতে আরজি দিয়ে মা, দাঁড়িয়ে আছি করপুটে।
কবে আদালতে শুনানি হবে মা, নিস্তার পাব এ সঙ্কটে॥
সওয়াল-জবাব করব কি মা, বুদ্ধি নাইকো আমার ঘটে।
ওমা ভরসা কেবল শিববাক্য ঐক্য বেদাগমে রটে॥
প্রসাদ বলে শমনভয়ে মা, ইচ্ছে হয় পালাই ছুটে।
যেন অন্তিমকালে জয়দুর্গা ব’লে, প্রাণ ত্যজি জাহ্নবীর তটে॥
মা আমার বড় ভয় হয়েছে
মা আমার বড় ভয় হয়েছে।
সেথা জমা ওয়াশীল দাখিল আছে॥
রিপুর বশে চল্লেম আগে, ভাবলেম না কি হবে পাছে।
ঐ যে চিত্রগুপ্ত বড়ই শক্ত, যা করেছি তাই লিখেছে॥
জন্ম-জন্মান্তরের যত, বকেয়া বাকী জের টেনেছে।
যার যেমনি কর্ম তেমনি ফল, কর্মফলের ফল ফলেছে॥
জমায় কমি খরচ বেশি, তরবো কিসে রাজার কাছে।
ঐ যে রামপ্রসাদের মনের মধ্যে (কেবল) কালীনাম ভরসা আছে॥
মা আমার খেলান হলো
মা আমার খেলান হলো।
খেলা হলো গো আনন্দময়ি॥
ভবে এলেম কর্তে খেলা, করিলাম ধূলা-খেলা,
এখন কাল পেয়ে পাষাণের বালা, কাল যে নিকটে এলো॥
বাল্যকালে কত খেলা, মিছে খেলায় দিন গোঁয়ালো।
পরে জায়ার সঙ্গে লীলা-খেলায় অজপা ফুরায়ে গেল॥
প্রসাদ বলে বৃদ্ধকালে অশক্ত কি করি বল।
ওমা শক্তিরূপা ভক্তি দিয়ে মুক্তিজলে টেনে ফেল॥
মন কেন মায়ের চরণছাড়া
মন কেন মায়ের চরণছাড়া।
মন ভাব শক্তি, পাবে মুক্তি, বাঁধ দিয়া ভক্তিদড়া॥
নয়ন থাকতে দেখলে না মন, কেমন তোমার কপাল পোড়া।
মা ভক্তে ছলিতে তনয়ারূপেতে, বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া॥
মায়ে যত ভালবাসে, বুঝা যাবে মৃত্যুশেষে।
মোলে দণ্ড দুচার কান্নাকাটি, শেষে দিবে গোবরছড়া॥
ভাই বন্ধু দারা সুত, কেবল মাত্র মায়ার গোড়া।
মোলে সঙ্গে দিবে মেটে কলসী, কড়ি দিবে অষ্টকড়া॥
অঙ্গেতে যত আভরণ, সকলই করিবে হরণ।
দোসর বস্ত্র গায়ে দিবে, চারকোণা মাঝখানে ফাঁড়া।
যেই ধ্যানে এক মনে, সেই পাবে মা তোমার তাড়া।
তখন একবার এসে কন্যারূপে, রামপ্রসাদের বেঁধো বেড়া॥
পতিতপাবনী তারা
পতিতপাবনী তারা।
ওমা কেবল তোমার নাম সারা॥
তরাসে আকাশে বাস, বুঝেছি মা কাজের ধারা॥
বশিষ্ঠ চিনিয়েছিল, হাড় ভেঙ্গে শাপ দিল।
তদবধি হইয়াছ ফণী যেন মণিহারা॥
ঠেকেছিলে মুনির ঠাঁই, কার্যকারণ তোমার নাই।
ঙয়ায় সয় তয় রয়, সেইরূপ বর্ণপারা॥
দশের পথে বটে সোজা, দশের লাঠি একের বোঝা।
লেগেছে দশের ভার, মনে শুধু চক্ষুঠারা॥
পাগল বেটার কথায় মজে’, এতকাল মলেম ভজে’।
দিয়াছি গোলামি খৎ, তুমি দেও মা ফারখৎ।
কালায় কালায় দাওয়া ঝুটা, সাক্ষী তোমার ব্যাটা যারা॥
বসতি ষোড়শদলে, ব্যক্ত হবে ভূমণ্ডলে।
প্রসাদ বলে কুতুহলে, তারায় লুকায় তারা॥
নিত্যই তোয় বুঝবে কেটা
নিত্যই তোয় বুঝবে কেটা।
বুঝে বুঝলি নাকো মনরে ঠেঁটা॥
কোথা রবে ঘরবাড়ী তোর, কোথা রবে দালান-কোঠা।
যখন আসবে শমন, বাঁধবে কষে মন, কোথা রবে বাপ খুড়া জেঠা॥
মরণসময় দিবে তোমায়, ভাঙ্গা কলসি ছেঁড়া চ্যাটা।
ওরে সেখানেতে তোর নামেতে, আছে যে রে জাবদা আঁটা॥
যত ধন জন সব অকারণ, সঙ্গেতে না যাবে কেটা।
রামপ্রসাদ বলে দুর্গা ব’লে ছাড়রে সংসারের লেঠা॥
আরও দেখুন: